ভারতকে ভারতবর্ষ বলা হয় কেন; পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও হিন্দুস্থান

ড. মোহাম্মদ আমীন
‘বর্ষ (√বৃষ্+অ)’ তৎসম শব্দ। উচ্চারণ /বর্‌শো/। অর্থ (বিশেষ্যে)—
  • বৎসর, বছর: শুভ নববর্ষ।
  • বৃষ্টি; মেঘ: যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পুণ্য দেশ।
  • অঞ্চল, এলাকা দেশ: বৎস, এই বর্ষ আমার জন্য নয়।
  • পুরাণে বর্ণিত নয়টি ভূভাগ: ১. ভারতবর্ষ। ২. কিম্পুরুষ। ৩. হরি। ৪. রম্যক। ৫. হিরণ্ময়। ৬. উত্তরকুরু। ৭. ইলাবর্ত। ৮. ভদ্রাশ্ব ও ৯. কেতুমালা।
পুরাণে বর্ণিত নয় ভূভাগের একভাগ হলো ভারতবর্ষ। তাই ভারত নামের ভূখণ্ডটি ‘ভারতবর্ষ’ নামে পরিচিত। অধিকন্তু, ‘বর্ষ’ শব্দের আরেকটি অর্থ অঞ্চল, এলাকা, দেশ, রাজ্য । ভারতবর্ষ শব্দের বর্ষ অর্থ বছর (year) নয়; এলাকা, অঞ্চল, দেশ, রাজ্য। অর্থাৎ ‘ভারতবর্ষ’ অর্থ পুরাণে বর্ণিত নয়টি ভূভাগের প্রথমটি; ভারতদেশ, ভারতরাজ্য, ভরতের দেশ। কথিত হয়, এই অঞ্চল বা বর্ষ রাজা ভরতকে দান করা হয়েছিল। তাই এর নাম ভারতবর্ষ। স্বাধীনতার পর ভারতের সংবিধানে ও লোকমুখে ভারত নামটিই মান্যতা লাভ করে।
.
অভ্র বসু লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষ’ শব্দটির ‘বর্ষ’ শব্দের অর্থ দেশ। ভরতের সন্ততি এই অর্থে ভারত শব্দের উদ্ভব। ভরত শব্দের ব্যুৎপত্তি ভৃ ধাতু থেকে।ভৃ+অত্= ভরত। দুষ্মন্ত এবং শকুন্তলার পুত্রের নাম ভরত,কারণ তিনি ভূপালনে কীর্তিমান ছিলেন। এ ভাবেও ভারত শব্দের উদ্ভব হতে পারে। হিন্দ্ বা হিন্দুস্তান বা india নামের উদ্ভব সিন্ধু শব্দ থেকে। ফারসিতে সিন্ধু হল হিন্দ্ বা হিন্দু। সেখান থেকেই লাতিন হয়ে গ্রিকে শব্দটা গেছে।লাতিনে পাওয়া যায় India শব্দটি।
পাকিস্তান, আফগানিস্তান, হিন্দুস্থান
 ‘স্তান’ ফারসি শব্দ এবং ‘স্থান’ সংস্কৃত শব্দ। পাক-ই-স্তান = পাকিস্তান এবং আফগান-ই-স্তান = আফগানিস্তান। তাই উৎস বিবেচনায় এই দুই শব্দের বানানে ‘স্থান’ লেখা সমীচীন নয়। যদিও শব্দের ব্যবহার, প্রয়োগ, প্রচলন বা জনপ্রিয়তা শব্দের উৎস কিংবা উৎপত্তির ধার ধারে না। অনেকে ‘আফগানিস্থান’ লিখে থাকেন। সৈয়দ মুজতবা আলী ‘বড়বাবু’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ইরানের সঙ্গে আফগানিস্থানের মনের মিল নেই, এদিকে তেমনি আফগান পাকিস্তানীতে মন-কষাকষি চলছে।” সৈয়দ মুজতবা আলী কেন ‘পাকিস্তান’ ও ‘আফগানিস্তান’ নামের দুই দেশের নামের বানানে একটিতে ‘স্তান’ এবং অন্যটিতে ‘স্থান’ লিখেছেন তার কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। যদিও ফারসি ‘স্তান’ এবং সংস্কৃত ‘স্থান’ প্রায় সমার্থক। সুভাস ভট্টাচার্য ‘বাংলা প্রয়োগ অভিধান’ গ্রন্থে বলেছেন, “তবু ইসলামি দেশনামে ‘স্তান’ লেখাই রীতি এবং হিন্দুস্থান শব্দে ‘স্তান’ লেখা সমীচীন নয়। ‘হিন্দুস্থান’ নামের উর্দু উচ্চারণ ‘হিন্দোস্তাঁ’ হলেও দীর্ঘ কাল ধরে হিন্দুস্থান’ বানানই বাংলায় বহুল প্রচলিত।” হয়তো ‘হিন্দু’ আর ‘স্থান’ শব্দের অভিন্ন উৎসই এর অন্যতম কারণ।

Leave a Comment

প্রতীক্ষা আর অপেক্ষার পার্থক্য; কিস মিস, ক্যাচ মিস ও কিশমিশ; বিবাহ বনাম সাঙা

ড. মোহাম্মদ আমীন

প্রতীক্ষা আর অপেক্ষার পার্থক্য; কিস মিস, ক্যাচ মিস ও কিশমিশ; বিবাহ বনাম সাঙা

প্রতীক্ষা আর অপেক্ষার পার্থক্য: প্রথমে বলে রাখি সাধারণত ‘প্রতীক্ষা’ ও ‘অপেক্ষা’ উভয় শব্দের অর্থগত কোন পার্থক্য নেই। অপেক্ষা অর্থ প্রতীক্ষা, প্রতীক্ষা অর্থ অপেক্ষা। সহজভাষায় উভয় শব্দের পার্থক্য এত কম যে, অপেক্ষার স্থলে প্রতীক্ষা ও প্রতীক্ষার স্থলে অপেক্ষা লেখা যায়। প্রতীক্ষার চেয়ে অপেক্ষার ব্যবহার ব্যাপক। শব্দদ্বয়ের পার্থক্য এত সুক্ষ্ম যে, গভীরভাবে নিরীক্ষণ না করলে পার্থক্য অনুধাবন করা অসম্ভব। উদাহরণ: অপেক্ষার যন্ত্রণা প্রতীক্ষার প্রহর/ প্রতীক্ষার অবসান অপেক্ষার নহর।
পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

সূক্ষ্ণ পার্থক্যটি কী তা আরও বিশদ করা যায়:

প্রতীক্ষা অর্থে যা ঘটতে পারে সে বিষয়ের জন্য অপেক্ষা করা। যেমন: অধীরচিত্তে বসিয়া যুবক প্রেয়সীর প্রতীক্ষায়। প্রতীক্ষার সময় সাধারণত অপেক্ষার সময় থেকে দীর্ঘতর। যেমন: তোমার জন্য দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি।
প্রতীক্ষার অবসান হয় না গো সখি।
ধৈর্য, নির্ভরতা, কারণ, শঙ্কা প্রভৃতি অর্থেও অপেক্ষা ব্যবহৃত হয়। যেমন:
অপেক্ষা সফলতার সেতু।
বৃষ্টির অপেক্ষায় কৃষিকাজ বন্ধ।
অপেক্ষার যন্ত্রণা মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহ।
একটি মন্তব্য : Mahin Dot Exe লিখেছেন, আমি ব্যাকরণ ভাল জানিনা। তবে মনে হয়েছে ‘প্রতীক্ষা’ এর ক্ষেত্রে এটি long term period, specific এবং এখানে একটা ফল বা অফল থাকবে আর ‘অপেক্ষা’ short term period এর ক্ষেত্রে এবং কোন ফলাফল হওয়ার আগেই এটা শেষ হতে পারে। উদাহরণ: “আমি তোমারি প্রতীক্ষায় থাকবো।” এখানে অপেক্ষার প্রহর (প্রতীক্ষা) ততদিন পর্যন্ত হবে যতদিন পর্যন্ত না উভয়ের মধ্যে মিলন/সাক্ষাত্ না ঘটে বা এমন কোন নিশ্চত খবর না আসে যে তার মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং সাক্ষাত্ আর হচ্ছে না।
কিস মিস, ক্যাচ মিস ও কিশমিশ: কিস, মিস, ক্যাচ মিস এবং কিশমিশ অভিন্ন ছন্দের শব্দ হলেও অর্থে রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য।
তোমার অধরে ওগো যে হাসির মধুমায়া- – –
“অধর নিশপিশ
নধর কিশমিশ।”
কিশমিশ ফারসি শব্দ।ছোটো বীজবিহীন একজাতীয় আঙুর শুকিয়ে কিশমিশ তৈরি হয়। অর্থাৎ কিশমিশ হচ্ছে বীজশূন্য ছোটো শুকনো আঙুর। সুতরাং, এর বানান ভুলেও কিসমিস লিখবেন না। তাহলে কিন্তু আপনার kiss, যাকেই দেন নিশ্চিত miss হয়ে যাবে। ক্যাচ, মিস হলে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু কিস, মিস কখনো মেনে নেওয়া যায় না। ক্যাচ মিস হলে একপক্ষের ক্ষতি হয় , কিন্তু কিস মিস হলে দুপক্ষেরই ক্ষতি।
ওপরের ছড়া পঙ্‌ক্তি দুটোর অর্থটা কি এমন হয়? তোমার অস্থির চঞ্চল ও অধীর অধরটি (নিচের ঠোঁট) কিশমিশের মতো টসটসে রসে পুষ্ট, সতেজ, কমনীয় ও লাবণ্যময়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এমন কিশমিশ বাংলাদেশে সহজে পাওয়া যায় না। আপনি এই কিশমিশকে কারওয়ান বাজারের সাধারণ কিশমিশ মনে করে বসলে মাইন্ড করব।
 .
বিবাহ বনাম সাঙা: সংস্কৃত বিবাহ (বি+√বহ্+অ) অর্থ— (বিশেষ্যে) নারী-পুরুষের স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে একত্র জীবন যাপনের সামাজিক অনুমোদন, বিয়ে, পরিণয়, উদ্‌বাহ, শাদিয়ে মোবারক। ‘সাঙা’ দেশি (সাঁওতাল) শব্দ। দেশি সাঙা অর্থ— (বিশেষ্যে) নারীর পুনর্বিবাহ; বিধবাবিবাহ। এক বা একাধিকবার বিয়ে হয়েছে, কিন্তু এখন বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান নেই এমন নারীর বিবাহ বা এমন নারী বিবাহ করাকে দেশি কথায় সাঙা বলে। এর আঞ্চলিক রূপ হাঙ্গা। সাঙা শব্দের আরেকটি অর্থ— বাঁশ দিয়ে তৈরি কাপড় রাখার তাকবিশেষ। সাঙাও এক প্রকার বিবাহ। তবে সব বিবাহ সাঙা নয়, কিন্তু সব সাঙা বিবাহ।
“সাঙার মাঝে সাঙার কাপড়
লুকিয়ে রাখে সাঙার খবর।
 সূত্র: কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: বাংলা বানান প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

Leave a Comment

উচ্চারণ: মৌলিক সূত্র: ই ঈ উ ঊ; বাংলায় উচ্চারণগত দীর্ঘস্বর; বাংলা হতে দীর্ঘস্বর তুলে দিলে কী হবে

ড. মোহাম্মদ আমীন

উচ্চারণ: মৌলিক সূত্র: ই ঈ উ ঊ; বাংলায় উচ্চারণগত দীর্ঘস্বর; বাংলা হতে দীর্ঘস্বর তুলে দিলে কী হবে

বাংলা বানানে দীর্ঘস্বর: উচ্চারণগত দীর্ঘস্বর

বাংলায় ধ্বনিমূলগত দীর্ঘস্বর নেই। হ্রস্ব ও দীর্ঘ উভয় স্বরের উচ্চারণ অভিন্ন। অনেকে এটি জানেন না। তাঁরা মনে করেন, দীর্ঘ-ধ্বনি দীর্ঘ-স্বরের এবং হ্রস্বধ্বনি হ্রস্ব-স্বরের প্রতীক। আসলে বাংলার জন্য তা যথার্থ নয়। বাংলায় উভয় ধ্বনির উচ্চারণ অভিন্ন। দেখি এ বিষয়ে অভিধান কী বলে: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, সংস্কৃতে ঈ-র উচ্চারণ দীর্ঘ হলেও বাংলায় তা হ্রস্ব এবং ই-র অনুরূপ। অর্থাৎ বাংলায়  এবং ঈ-এর উচ্চারণ অভিন্ন। সংস্কৃতে ঊ-র উচ্চারণ দীর্ঘ হলেও বাংলায় হ্রস্ব এবং উ-র মতো। অর্থাৎ বাংলায়  এবং ঊ-এর উচ্চারণ অভিন্ন।
.
অর্থাৎ বাংলা ভাষার শব্দে ব্যবহৃত হ্রস্ব ও দীর্ঘস্বরের কাজ উচ্চারণে ভিন্নতা আনয়ন নয়; অর্থদ্যোতনার ভিন্নতা আনয়ন।উচ্চারণ-দ্যোতনায় এর ভূমিকা নেই। যেমন: ইদ/ঈদ, দিন/দীন, কুল/কূল, চির/চীর, চিন/

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

চীন, দুর/দূর, বিনা/বীণা, শব্দজোড়ের উচ্চারণ অভিন্ন। তাই ইভ ও ঈভ, পির ও পীর, ঈশ ও ইস, নিচ ও নীচ কিংবা মুল ও মূল, কুল ও কূল প্রভৃতি শব্দে অর্থগত পার্থক্য থাকলেও উচ্চারণগত কোনো পার্থক্য নেই। বিদেশি ভাষার কোনো শব্দ বাংলায় এলে তাকে বাংলা ভাষায় বিদ্যমান বর্ণ-চিহ্ন এবং তার উচ্চারণগত বৈশিষ্ট্য দিয়ে যতটুক পারা যায় কেবল ততটুকুই অতিথি ভাষার স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রেখে বাংলায় প্রতিপাদন করা হয়। একভাষার উচ্চারণকে অন্য ভাষার ধ্বনি দিয়ে কখনো অভিন্নভাবে উচ্চারণ করা বা করানো ঠিক নয়। করিমকে দিয়ে জাফরের কণ্ঠ অবিকল দ্যোতিত করা সম্ভব নয়। তা করতে গেলে উচ্চারণ আরও বিকৃত হয়ে যাবে।

.
তাহলে যেসব বিদেশি ভাষায় উচ্চারণগত দীর্ঘস্বর আছে সেসব শব্দের বাংলা বানান কেমন হবে?   এক ভাষার শব্দকে অন্য ভাষার বর্ণ দিয়ে অবিকল উচ্চারণানুগ শব্দে প্রকাশ করা অসম্ভব। পৃথিবীর কোনো ভাষাতে এটি সম্ভব নয় এবং ভাষার স্বকীয় মর্যাদা বজায় রাখার জন্য এমনটি করাও হয় না। বিদেশি ভাষার কোনো শব্দ বাংলায় এলে তাকে বাংলা ভাষায় বিদ্যমান বর্ণ-চিহ্ন দিয়ে যতটুক পারা যায় কেবল ততটুকুই অতিথি ভাষার স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রেখে প্রতিপাদন করা হয়।বিদেশি কোনো শব্দকে বাংলায় এনে ওই ভাষার অনুরূপতা বজায় রাখার জন্য নিজ ভাষার স্বকীয়তা, ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যরাশিকে বিসর্জন দেওয়া অত্মবৈশিষ্ট্য বিলিয়ে দেওয়ার তুল্য। বাঙালি ছাড়া আর কেউ, মাতৃভাষায় আগত অতিথি-শব্দকে উৎস শব্দের অনুরূপ মর্যাদা দিতে গিয়ে নিজের ভাষার সম্মান ও চরিত্র বিসর্জন দিয়ে দেয় না। মাতৃভাষার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাষা আর কী হতে পারে! অবশ্য যে দেশের অনেকে, বিয়েশাদিসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের চিঠিপত্রে এখনও ইংরেজি ভাষার ব্যবহারকে মর্যাদাময় গণ্য করেন, সে দেশের মানুষের মাতৃভাষা প্রেম, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, স্বকীয় দ্যোতনা ও আত্মসম্মানবোধ কত ঠুনকো তা সহজে অনুমেয়।
.
বাংলা ভাষার শব্দে ব্যবহৃত দীর্ঘস্বরের কাজ অর্থদ্যোতনার ভিন্নতা আনয়ন।উচ্চারণ-দ্যোতনায় এর কোনো ভূমিকা নেই। যেমন : দিন/দীন, কুল/কূল, চির/চীর, চিন/চীন, দুর/দূর, বিনা/বীণা, শব্দজোড়ের উচ্চারণ অভিন্ন। তাই ইভ ও ঈভ, পির ও পীর, ঈশ ও ইস, নিচ ও নীচ কিংবা মুল ও মূল, কুল ও কূল প্রভৃতি শব্দে অর্থগত পার্থক্য থাকলেও উচ্চারণগত কোনো পার্থক্য নেই। তাই বাংলা বানানে সমতা আনয়ন জন্য এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখার জন্য বাংলা একাডেমি অতৎসম শব্দের বানানে সংস্কৃত প্রভাবিত বলে পরিচিত ঈ, ঊ, ঋ ণ, ষ প্রভৃতি ধ্বনি ব্যবহার না করার নির্দেশনা দিয়েছেন। কারণ, বাংলায় উচ্চারণগত দীর্ঘস্বর নেই, যে স্বরই দেওয়া হোক উচ্চারণ অভিন্ন হবে।  বিশেষ কারণে ব্যতিক্রম বিষয়টি খুব সীমিত মাত্রায় বিবেচনা করা যায়।তবে এটি করতে গিয়ে সমতা বিধানের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করা সমীচীন হবে না।

বাংলা হতে দীর্ঘস্বর তুলে দিলে কী হবে

বলা হয়, বাংলায় উচ্চারণগত দীর্ঘস্বর নেই। তাহলে বাংলা হতে দীর্ঘস্বর তুলে দেওয়া হয় না কেন? বাংলায় অভিধানভুক্ত শব্দের সংখ্যা প্রায় ১,৬০,০০০ (যদিও মোট শব্দ সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ)। অভিধানভুক্ত এই ১,৬০,০০০ শব্দের মধ্যে তৎসম প্রায় ২৫ ভাগ বা ৪০,০০০ এবং অর্ধ-তৎসম ৫ ভাগ বা ৮,০০০ ও তদ্ভব ৬০ ভাগ বা ৯৬,০০০মূলত তৎসমের অর্থগত পার্থক্য দ্যোতিত করার জন্য সংস্কৃতের অনুরূপ বানান হিসেবে তৎসম শব্দের জন্য বাংলায় দীর্ঘস্বর রাখা হয়েছে।তৎসম তুলে দিলেই কেবল বাংলায় দীর্ঘস্বরের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে। অর্থাৎ, দীর্ঘস্বর তুলে দিলে তৎসম শব্দ আর থাকবে না। সেক্ষেত্রে বাংলায় ব্যবহৃত প্রায় ৪০,০০০ এবং অভিধান বহির্ভূত আরও ১০,০০০ মোট ৫০,০০০ তৎসম শব্দে সরাসরি বানান ও অর্থ বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। পরোক্ষ বিপর্যয় ঘটবে ১,০৪০০০ সংস্কৃতজাত (অর্ধ-তৎসম ও তদ্ভব) শব্দে । বাংলাদেশের বাংলায় দীর্ঘস্বর তুলে দেওয়া হলে পশ্চিমবঙ্গ তা করবে এমনটি বলা যায় না। যদি না করে তো কী হবে?

অভিধানভুক্ত ১,৬০,০০০ শব্দের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১,৪৪,০০০ শব্দের বানান ও অর্থ বিপর্যয় ঘটবে। বাকি থাকে ১৬,০০০। তাই যদি হয় তো বাংলাদেশের বাংলা আর পশ্চিমবঙ্গ ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বাংলা ভিন্ন ভাষায় পরিণত হবে। ১৬,০০০ শব্দ ছাড়া বাকি ১,৪৪,০০০ শব্দ তাদের কাছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অপরিচিত হয়ে যাবে। আমাদের খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের লেখা ভবিষ্য-প্রজন্ম বুঝবে না। তাই দীর্ঘস্বর তুলে দেওয়া এত সহজ কাজ নয়।
.
তবে কালের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে দীর্ঘস্বর উঠে গেলে সে অন্য কথা। বাংলায় ব্যবহৃত অভিধানভুক্ত বিদেশি শব্দের সংখ্যা (৮% হিসেবে) ১২,৮০০ এবং দেশি শব্দের সংখ্যা (২% হিসেবে) ৩,২০০। প্রশ্ন আসতে পারে, বাংলার প্রাচীন লোকজন কি তাহলে মাত্র ৩২০০ শব্দ দিয়ে আলাপ-আলোচনা করত? না। বারবার আগ্রাসনের কবলে পড়ে বিজেতা জাতির ভাষার থাবায় সমৃদ্ধ দেশি ভাষার অধিকাংশ দেশি শব্দ ক্রমশ লুপ্ত হতে হতে এ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এভাবে আগ্রাসনের কবলে পড়ে অনেক সমৃদ্ধ ভাষাও লুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলার ভাগ্য ভালো যে, অন্তত বাংলা নামে সে টিকে আছে। অথচ আগ্রাসনের কবলে পড়ে বাংলার চেয়ে অনেক বেশি ভাষাভাষীর ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে বিলকুল।

বাংলা উচ্চারণে দীর্ঘস্বরের ভূমিকা

বাংলায় ই এবং  আর  এবং ঊ পরস্পর সমোচ্চারিত। —- সাধারণ শিক্ষিতের কথা বাদই দিলাম, সিংহভাগ উচ্চশিক্ষিত বাংলাদেশি জানেন না যে, বাংলা উচ্চারণে ধ্বনিমূলগত কোনো দীর্ঘস্বর নেই। অভিধানে শব্দের পাশে দেওয়া উচ্চারণ দেখলে বিষয়টি বুঝতে পারবেন। শব্দস্থ দীর্ঘস্বর কেবল সংশ্লিষ্ট শব্দ/পদের অর্থ-পার্থক্য নির্দেশ করে। এজন্য ইদ/ঈদ, কুল/কূল, চিন/চীন, তির/তীর, দিন/দীন, ধুম/ধূম, নিচ/নীচ, বেশি/বেশী মুখ্য/মূখ্য, সুত/সূত প্রভৃতি শব্দজোড় সমোচ্চারিত। এ শব্দরাশির দীর্ঘস্বর উচ্চারণের পার্থক্য নির্দেশ করে না, কেবল অর্থের পার্থক্য নির্দেশ করে। যাদের বাংলা বানান, ধ্বনিমূল ও উচ্চারণরীতি সম্পর্কে ধারণা নেই তাদের মন্তব্য করা নিষ্প্রয়োজন। কেউ মন্তব্য করতে বাধ্য নন। আপ্রাসঙ্গিক বা ভিত্তিহীন মন্তব্য অজ্ঞতার পরিচায়ক। অশোভনও বটে। মন্তব্য করার আগে বিষয়টি খেয়াল রাখলে বাধিত হব।

Leave a Comment

চুপ, বাসব ভালো খুব

ড. মোহাম্মদ আমীন

চুপ, বাসব ভালো খুব

কথাটি বলেই বিপদে পড়ে গেলাম। ছেলেটি রেগে গেল আকস্মিক। মন খারাপ করে আহারের ইতি টেনে চোখ দুটো কবুতরের ডিমের মতো গোল করে আমার দিকে একবার তাকিয়ে হাত ধুয়ে নিল তাড়িগড়ি।
বললাম, রাগ করো না বাবা, খেয়ে নাও।
‘চুপ’ বললে কেন?
‘চুপ’ ছোট্ট একটা কথা।
না, ছোটো নয়। ক্লাসে চুপ শুনতে শুনতে কানটা জঙ্গি বিমানের ইঞ্জিন হয়ে গেছে। সবাই এত চুপ চুপ করে কেন? যারা চুপ করতে বলে তারা তো চুপ করে না? সারাক্ষণ শুধু চুপ চুপ করে যায়।
ঠিকই বলেছে ছেলেটি। অফিসে, রাস্তায়, দোকানে, সেলুনে সর্বত্র চুপ শুনতে শুনতে চুপটাই এখন বিগব্যাং। সবাই বলে চুপ। তারপরও কেউ চুপ না। বরং চুপ শব্দটাই পুরো দেশটাকে চুপিচুপি মাছের বাজার করে দিয়েছে। চুপি চুপি বলো কেউ জেনে যাবে,জেনে যাবে কেউ জেনে যাবে; সবাই যে জেনে গেছে-এটা কারও মাথায় ঢুকে না। গানও থামে না।
কেন চুপ বললে? অভিমানে ছেলের গলায় বিগলিত অনুরাগ। আমি লজ্জায়।
আদর করে বললাম। চুপ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর কথা।
কীভাবে?
“চুপ চুপ লক্ষ্মীটি শুনবে যদি গল্পটি
এক যে ছিল তোমার মতো ছোট্ট রাজকুমার।” গানটি শোনোনি?
শুনেছি, গেয়েছি।
আদুরে না হলে লক্ষ্মীকে চুপ বলত?
না।
এবার রাগ গেল তো? খেয়ে নাও। এ বয়সে উপাহার ভালো না।
আরও প্রমাণ চাই।
বললাম, চুপ হচ্ছে সেরা ভালোবাসার সেরা কথা।
কে বলেছেন?
রবীন্দ্রনাথ-দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর/ ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর।
এটা তো রবীন্দ্রনাথ বলেননি?
কে বলেছেন? আমি জানতে চাইলাম।
“For God sake, hold your tongue and let me love” এ তো John Donne-এর কবিতার লাইন। রবীন্দ্রনাথ বঙ্গানুবাদ করেছেন। তুমি বঙ্গানুবাদ করো।চুপ যদি ভালোভাবে দিতে পার তারপর বলব, রাগ গেছে কি না।
“চুপ চুপ চুপ
বাসব ভালো খুব।
চুপ চুপ চুপ
মনে ভরে দেখব আমার রাজকুমারের রূপ।”- এবার হলো?
চুপ চুপ চুপ
বাবা আমায় ভালোবাসে আর মনে নেই ক্ষোভ।
চুপ চুপ চুপ।

Leave a Comment

কর কর করো কোরো

ড. মোহাম্মদ আমীন

কর কর করো কোরো

.https://draminbd.com/কর-কর-করো-কোরো/

অভিধানে ভিন্ন ভুক্তিতে চারটি ‘কর’ রয়েছে। তন্মধ্যে তিনটি সংস্কৃত/তৎসম ‘কর’ এবং একটি বাংলা ‘কর’।
১. কর: কৃৃ-ধাতু থেকে উদ্ভূত তৎসম ‘কর (√কৃৃৃৃৃৃৃৃৃ +অ)’ অর্থ (বিশেষ্যে) রাজস্ব, শুল্ক, খাজনা, tax। কর ফাঁকি দেওয়া ঠিক নয়। সে আয়ক বিভাগে চাকুরি করে।
২. কর: সংস্কৃত কৃ-ধাতু থেকে উদ্ভূত তৎসম ‘কর (√কৃ+অ)’ অর্থ (বিশেষ্যে)—
  • পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

    হস্ত, হাত: তিনি করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। মানুষের দুটি কর

  • হাতির শুঁড়: হাতি তার করে প্রায় ৫ লিটার জল রাখতে পারে।
  • কিরণ, রশ্মি, আলো: আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর (রবীন্দ্রনাথ)।
  • পদবিশেষ: তার নাম কৃষ্ণকুমার কর

৩. -কর: তৎসম ‘কর (কৃ+অ)’ অর্থ (বিশেষণে)
  • উৎপাদক, সৃজক জনক প্রভৃতি অর্থ প্রকাশ করে এমন: কল্যাণকর, মঙ্গলকর, অনিষ্টকর)।
  • স্রষ্টা, নির্মাতা: চিত্রকর চিত্র আঁকে। শালকর শার উৎপাদন করে। স্মর্তব্য, এই ‘কর’ সর্বদা সংশ্লিষ্ট শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে।
৪. কর: বাংলা ‘কর’ অর্থ অনুজ্ঞা ক্রিয়ায় (অবজ্ঞার্থে/তুচ্ছার্থে/স্নেহার্থে) করার অনুজ্ঞা: কাজটি কর। বাবা একটু তাড়াতাড়ি কর। ক্রিয়াজ্ঞাপক ‘কর’ দিয়ে কর্, করো, কোরো— তিনটাই বোঝায়। কখন কোনটি হবে তা নির্ভর করে বাক্যের ওপর। কিন্তু বুঝবেন কীভাবে?
ক. তুচ্ছার্থক ক্রিয়াপদের শেষে আগে হস্-চিহ্ন দেওয়া হতো। যেমন: তুই কাজটি কর্। আমার সাথে চল্। কথাটি কী বল্। চোরটাকে ধর্‌। এখন হস্-চিহ্ন দেওয়া হয় না।
খ. ‘তুমি’ সর্বনামে তৎক্ষণাৎ নির্দেশের ক্ষেত্রে ও-কার বিধেয়। যেমন: এখনই কাজটি করো। পড়তে শুরু করো। এক্ষুনি আমার সঙ্গে চলো। কথাটা কী বলো।
গ. তুমি-এর ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ নির্দেশের ক্ষেত্রে দুটো ও-কার ব্যবহার করা যায়। যেমন: এক মাসের মধে কাজটি কোরো। খাওয়ার পর ঘটনাটা বোলো।
আয়কর দিতে আয় কর,
দুই কর জোড় করে দাঁড়িয়ে দিবাকর।
সূত্র: কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়াপদে ও-কার

‘কর’ বলতে কর্, করো, কোরো— তিনটাই বোঝায়।
ধরো শব্দ দিয়ে ধর, ধরো, ধোরো— তিনটি কথাই প্রকাশ করে। কোনটি হবে তা নির্ভর করে বাক্যের ওপর। কিন্তু বুঝবেন কীভাবে?
ক. তুচ্ছার্থক ক্রিয়াপদের শেষে আগে হস-চিহ্ন দেয়া হতো। যেমন: তুই কাজটি কর। আমার সাথে চল্। কথাটি কী বল্। চোরটাকে ধর্‌। এখন হস-চিহ্ন দেওয়া হয় না।
খ. ‘তুমি’ হলে তৎক্ষণাৎ নির্দেশের ক্ষেত্রে ও-কার বিধেয়। যেমন: এক্ষুনি আমার সঙ্গে চলো। কথাটা কী বলো। এখনই কাজটি করো। পড়তে শুরু করো।
গ. তুমি-এর ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ নির্দেশের ক্ষেত্রে দুটো ও-কার ব্যবহার করা যায়। যেমন— এক মাসের মধে কাজটি কোরো। খাওয়ার পর ঘটনাটা বোলো।
সূত্র: ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

Leave a Comment

চাপাবাজ: অর্থ উৎপত্তি ও স্বরূপ

ড. মোহাম্মদ আমীন

চাপাবাজ: অর্থ উৎপত্তি ও স্বরূপ

‘চাপা’ ও ‘বাজ’ মিলে চাপাবাজ। ‘চাপাবাজ’ শব্দের ‘চাপা’, ক্রিয়াবিশেষ্য ও বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা ‘চাপা’ নয়। ‘চাপাবাজ’-এর ‘চাপা’ আঞ্চলিক ‘চাপা’। আঞ্চলিক ‘চাপা’-র সঙ্গে ফারসি ‘বাজ’ মিলে ‘চাপাবাজ’। এবার দেখা যাক, আঞ্চলিক ‘চাপা’ কী। … … …। শহীদুল্লাহ্ সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমী বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান [দ্বিতীয় পুনর্মুদ্রণ এপ্রিল ২০০০ (পৃষ্ঠা ২৮৪)]’ বলছে, আঞ্চলিক (যশোর ময়মনসিংহ) ‘চাপা’ অর্থ (বিশেষ্যে) চোয়াল।…
—তুমি কোন কোন দেশ ঘুরছ?
—আমেরিকা রাশিয়া চীন জাপান আফ্রিকা অষ্ট্রেলিয়া ব্রাজিল কানাডা ফ্রান্স লন্ডন হংকং নাউরু সিঙ্গাপুর ডেনমার্ক মিশর ওমান— আরও অনেক দেশ ঘুরছি।
—তাহলে তো তুমি জিওগ্রাফি সম্পর্কে অনেক কিছু জানো?
—জানি মানে! পাঁচবার জিওগ্রাফি গিয়েছি। আমি তো এখন জিওগ্রাফি থেকে ফিরছি। দেশটা যে কী সুন্দর! ছবি দেখবেন?
.
চাপাবাজির একটা উদাহরণ দিলাম। … … … কোনো কাজ বা বিষয় অনৈতিক, অসত্য, ধাপ্পাপূর্ণ, অসাড়, হাস্যকর, বিরক্তিকর, বিবেচনাহীন ও বাতিকগ্রস্ত হলে তার সঙ্গে নেতিবাচক ‘বাজ’ প্রত্যয় যুক্ত করা হয়। যেমন: চালবাজ, চাঁদাবাজ, তেলবাজ, তোলাবাজ . . .। কারও চাপা বা গাল দিয়ে বের হয়ে আসা কথা অনৈতিক, মিথ্যা, ধাপ্পাপূর্ণ, অসাড়, বিরক্তিকর, বিবেচনাহীন ও বাতিকগ্রস্ত হলে ওই গাল বা চাপাধারীকে চাপাবাজ বলা হয়। সবচেয়ে, মজার বিষয় হচ্ছে, চাপাবাজকে ‘চাপাবাজ’ বললে ‘চাপাবাজ’ ভীষণ রেগে গিয়ে আরও অধিক চাপাবাজি শুরু করে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চাপাবাজি চলে টকশো আর রাজনীতিতে। এখন তো, টকশো আর চাপাবাজি এবং এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার হীন প্রয়াস সমার্থক হয়ে গেছে।
.
গবেষণা বলছে, তিন-ব ছাড়া চাপাবাজদের আরও কেউ সহজে থামাতে পারে না। তিন ‘ব’-এর প্রথম ‘ব’ বন্ধ (অনুষ্ঠান বন্ধ করা); দ্বিতীয় ‘ব’ হলো বউ এবং তৃতীয় ‘ব’ হলো বস। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, চাপাবাজরা কেবল নিজের মতবাদ বা দাবি প্রতিষ্ঠা কিংবা প্রতিপক্ষকে হেয় বা অপদস্থ বা নিজেকে সবদিকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত করার জন্য কোনোরূপ তথ্য তত্ত্ব ও ভিত্তি ছাড়া অবিবেচকের মতো অযৌক্তিকভাবে সত্যমিথ্যার তোয়াক্কা না করে এবং প্রতিপক্ষের কথা না শুনে বা বলার সুযোগ না দিয়ে চিল্লাচিল্লির মাধ্যমে অবিরল নিজের বক্তব্য বলে যেতে থাকে। চাপাবাজরা নিজেও জানে যে, তাদের কথা মিথ্যা, তবু উন্মাদের মতো বলে যেতে থাকে। মনে করে এতে তাদের মর্যাদা বাড়ে; প্রকৃতপক্ষে এ কারণে যে, তাদের হাসির পাত্র হতে হয়।
.
এটি একটি রাজনীতিক শব্দ। প্রতিপক্ষকে হেয় আর নিজেকে বা নিজের দলকে শ্রেষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে কিংবা প্রতিশ্রুতি প্রদানে বহুল চাপাবাজি লক্ষণীয়। দশ টাকা কেজির চাল খাওয়াব, ঘরে ঘরে গাড়ি দেব, আমাদের দল ছাড়া সবাই গণশত্রু, ক্ষমতায় গেলে পানির দাম আর তেলের দাম সমান করে দেব, আমাদের নেতা ছাড়া অন্য দলের সবাই সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ প্রভৃতি চাপাবাজি হামেশা শোনা যায়।
চাপাবাজদের মাথায় মগজ থাকে না, সব মগজ চোয়াল হয়ে যায়। তাই কী বলে না বলে অনুধাবন করতে পারে না। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, এটি একটি মানসিক রোগ। তাই চাপাবাজদের ‘চাপাবাজ’ বললে ভীষণ রেগে যায়। যেমন রেগে যায় পাগলকে পাগল বললে।

Leave a Comment

মুসলিম হারাল রাশিয়া: অ্যালকোহল নিষিদ্ধ করতে গিয়ে রাশিয়া হারাল মুসলিম

ড. মোহাম্মদ আমীন
ভ্লাদিমির দ্যা গ্রেট ছিলেন রাশিয়ার, তৎকালীন কিয়েভ রাস-এর শাসক। তিনি সেইন্ট ভ্লাদিমির নামেও পরিচিত ছিলেন। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সিংহ ভাগই ছিল তার শাসনাধীন। ভ্লাদিমিরের পিতা সিটোসলাস (Sviatoslav) ছিলেন রুরাক রাজবংশের শাসক। তিনি ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই জুন থেকে ১০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুলাই পর্যন্ত রাশিয়ার শাসক ছিলেন। ভ্লাদিমির ৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুলাই মারা যান। জন্মগতভাবে তিনি ছিলেন প্যাগান। চতুর্থ শতকে প্যাগান শব্দটির উদ্ভব। তখন পাগান বলতে রোমান সাম্রাজ্যের সেসব লোকদের বোঝানো হতো, যারা একাধিক দেব-দেবী এবং একাধিক ঈশ্বর বিশ্বাস করতেন। এখন সাধারণভাবে নন- আব্রাহামিক বা স্বল্প-পরিচিত ধর্মানুসারীদের প্যাগান বলা হয়। বলাবহুল্য, ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং মুসলিমদের নন-প্যাগান বা আব্রাহামিক ধর্মানুসারী বল হতো
৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ভ্লাদিমির প্যাগান ধর্ম ত্যাগ করে আব্রাহামিক ধর্মীয় বিশ্বাস গ্রহণে অনুপ্রাণিত হন এবং ওই ধর্মটিকে রাশিয়ার জাতীয় ধর্ম ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেন। । জাতীয় ধর্ম ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য ভ্লাদিমির তাঁর বয়ারগণকে ডাকলেন। উল্লেখ্য, আঞ্চলিক শাসক, সামরিক নেতা, উচ্চপদস্থ রাজকীয় কর্মকর্তা ও অভিজাতদের বয়ার বলা হতো। ভ্লাদিমির, আব্রাহামিক ধর্মগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য প্রতিবেশি রাষ্ট্রসমূহে প্রতিনিধি প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রতিনিধি দলের নেতাদের এটাও নির্দেশ দিলেন যে, রাশিয়া ফেরত আসার সময় যেন সংশ্লিষ্ট ধর্ম সম্পর্কে অভিজ্ঞ, স্বীকৃত ও খ্যাতিমান একজন নেতা নিয়ে আসেন।
.
তখন ভলগা রাজ্য হিসেবে পরিচিত ভূখণ্ডটি ছিল মুসলিম প্রভাবাধীন। সপ্তম হতে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত স্থায়ী রাজ্যটি ভলগা ও কামা নদীর ঐশ্বর্যকে ঘিরে গড়ে ওঠেছিল। বস্তুত বর্তমানে উরোপীয়ান রাশিয়া হিসেবে পরিচিত বিশাল ভূখণ্ডটিই ছিল তৎকালীন ভলগা রাজ্য। কিছুদিন পর দূতগণ ফেরত এলেন। ভ্লাদিমির দ্যা গ্রেট ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে জানার জন্য ইহুদিদের কাছে প্রেরিত দূতকে তলব করলেন। দূত বললেন, আব্রাহামিক ধর্মসমূহের মধ্যে এটিই প্রথম। তাদের ঈশ্বরকে জেওভা বলা হয়। জেরুজালেম ইহুদিদের ধর্মীয় পবিত্রতম স্থান। তবে এটি এখন মুসলমানদের দখলে।
.
দূতের কথা শুনে ভ্লাদিমির বললেন, জেরুজালেম হতে ইহুদিরা বিতিাড়িত হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, জেওভাও তাদের পরিত্যাগ করেছে। অতএব, ইহুদি ধর্ম রাশিয়ার জাতীয় ধর্ম হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
এরপর খ্রিষ্টানদের কাছে প্রেরিত দূতকে ডাকা হলো। দূত বললেন, ল্যাটিন আচার-অনুসারী খ্রিষ্টানদের চার্চগুলো আকর্ষণীয় নয়। তারা পশ্চাৎমুখী। রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটানটিনোপল-এ অবস্থিত চার্চগুলো বেশ আকর্ষণীয়। বাইজেন্টাইনের শাসক, আপনার প্রতি সম্মানস্বরূপ উপহার পাঠিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন ভবিষ্যতে কোনো প্রয়োজনে আপনার পাশে থাকবেন। খ্রিষ্টান অর্থডক্স ধর্মীয় পুরোহিতও আপনার জন্য স্মারক উপহার পাঠিয়েছেন। হাগিয়া সোফিয়ায় অবস্থিত যিশু খ্রিষ্টের গ্রেট চার্চ পৃথিবীর সেরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। তারা ঈশ্বরকে গড বলে।
.
দূতের কাছে হাগিয়া সোফিয়ায় অবস্থিত যিশু খ্রিষ্টের গ্রেট চার্চের বিবরণ শুনে ভ্লাদিমির চমৎকৃত হলেন। তিনি উপহারগুলো নিয়ে মুসলিমদের কাছে প্রেরিত দূতকে অভিজ্ঞানের বিবরণ প্রদানের নির্দেশ দিলেন।
মুসলিমদের কাছে প্রেরিত দূত বললেন, মুসলিমদের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস নেই। পার্থিব জীবনকে তারা স্বর্গীয় শান্তির প্রত্যাশায় দুঃখময় ও অস্থির করে রাখে। তবে ইসলাম খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এখন পৃথিবীতে তারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান এবং আগ্রাসী। যে কোনো রাজ্য সহজে দখল করে ফেলার সামর্থ্য তাদের আছে। তাদের ঈশ্বরের নাম আল্লাহ।
ভ্লাদিমির বললেন, ইসলাম দ্রুত সম্প্রারিত হচ্ছে, মুসলিমগণ রাজ্যের পর রাজ্য দখল করছে- তার মানে আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন।
ভ্লাদিমির বয়ারগণের সঙ্গে আলোচনা করে ইসলামকে রাশিয়ার জাতীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রাথমিক কার্যাবলি সম্পন্ন করার বিষয়ে অভিমত নেওয়ার জন্য ভ্লাদিমির, মুসলিম রাষ্ট্র থেকে আগত ইসলাম ধর্মীয় প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন।
.
ভ্লাদিমির ইসলাম ধর্মীয় প্রতিনিধিকে বললেন, আমার রাজ্যধর্ম হবে ইসলাম। আমরা সবাই একযোগে ইসলাম গ্রহণ করাব। আমাদের কী করতে হবে বলুন?
প্রতিনিধি বললেন, আপনার রাজ্যে মদের ছড়াছড়ি। ইসলাম ধর্মে অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ। অতএব আপনার রাজ্যে এটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করুন।
ভ্লাদিমির বললেন, অ্যালকোহল পান রাশিয়ানদের একটি আনন্দ। আনন্দ ছাড়া আমরা বাঁচতে পারব না। প্রজা সাধারণ বিষয়টি মেনে নিতে পারবে না। আপনি বরং অন্য কিছু বলুন।
প্রতিনিধি বললেন, আগে অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ করুন।
ভ্লাদিমির দ্যা গ্রেট তাঁর বয়ারদের সঙ্গে আলাপ করে বললেন, তাৎক্ষণিকভাবে অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ করা সম্ভব হবে না। জনগণ ক্ষুব্ধ হবে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। জনগণের আনন্দের বিষয়কে এত দ্রুত নতুন কোনো ধর্মীয় বিধি দিয়ে নিষিদ্ধ করলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আগে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণা করে দিই। পরে অ্যালকোহলের বিষয়টি ধীরে ধীরে বিবেচনা করা হবে।
মুসলিম প্রতিনিধি বললেন, আগে অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ করুন। নইলে জাতীয় ধর্ম হিসেবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না।
এরপর ভ্লাদিমির, অর্থডক্স খ্রিষ্টানের প্রতিনিধিকে ডেকে বললেন, আমি আমার রাজ্যে অর্থডক্স খ্রিষ্টানিটিকে জাতীয় ধর্ম ঘোষণা করতে চাই। আমরা সবাই আপনার ধর্ম গ্রহণ করব। আমাদের কী করতে হবে বলুন?
খ্রিষ্টান প্রতিনিধি বললেন, আগে আপনি অর্থডক্স খ্রিষ্টানিটিকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করুন। তারপর ধীরে ধীরে আপনার জনগণের ইচ্ছা, রাষ্ট্রীয় নীতি এবং ধর্মীয় বিধিবিধানের সমন্বয় করা যাবে। দীর্ঘদিন চলে আসা প্রথা, আচরণ এবং অভ্যাসকে দ্রুত পরিবর্তন আমার ধর্মীয় বিধানের পরিপন্থী।
ভ্লাদিমির বললেন, অ্যালকোহল পান করা যাবে?
পাদ্রি বললেন, ঈশ্বরপুত্র যিশু অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ করেননি। সবার আগে আমাদের পার্থিব জীবনকে সমৃদ্ধ ও আনন্দময় করতে হবে। তারপর স্বর্গ।
খ্রিষ্টান প্রতিনিধির কথা শুনে ভ্লাদিমির খুশি হলেন এবং ইসলামের পরিবর্তে অর্থডক্স খ্রিষ্টানিটিকে জাতীয় ধর্ম ঘোষণা করেন। এরপর থেকে রাশিয়ায় ইসলাম ধর্ম কোনঠাসা হতে শুরু করে অবশেষে একদম প্রভাবশূন্য হয়ে যায়।
—————————————————————————-
খ্রিষ্টান ইতিহাসবেত্তা এ্যান্টিয়স-এর ইয়াহিয়া, আল-মকিন, মুসলিম ভুগোলবিদ ও ইতিহাসবেত্তা আল দিমাস্কি এবং ইবনে আল আথির বর্ণনায় ভ্লাদিমির দ্যা গ্রেট-এর ধর্মগ্রহণের বিবরণ পাওয়া যায়। দিমাস্কি ছিলেন মামলুক সুলতান বেইবারস (Baibars) এর সামসময়িক। তার ডাক নাম আবু আল ফুথু। তিনি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন।

Leave a Comment

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি মানে ষাঁড় ইউনিভার্সিটি

প্রমিতা দাশ লাবণী

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি মানে ষাঁড় ইউনিভার্সিটি

গো +এষণা’ থেকে গবেষণা। ভারতবর্ষের পণ্ডিতগণ ‘গো’ খোঁজার মধ্যে গবেষণার নিষ্ঠা খুঁজে পেয়েছিলেন। ইংল্যান্ড বা যুক্তরাজ্যের পণ্ডিতগণ এই নিষ্ঠা খুঁজে পেয়েছিলেন ষাঁড়-পারাপারে। ওদের নিষ্ঠা ছিল সহিংসতায়, আর ভারতবর্ষের নিষ্ঠা ছিল দুর্বলতার আড়ালে সৃজিত স্নিগ্ধ মমতায়। তবে উভয়ের একটা বিষয়ে চমৎকার মিল ছিল— ভারতবর্ষেও ‘গো’ মানে যাওয়া এবং ওখানেও ‘go (গো)’ মানে যাওয়া। আমরা ব্যস্ত ছিলাম কেবল যাওয়া-আসায় আর ওরা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়ত দেশ দখলে। উভয়ের মধ্যে এটি ছিল মৌলিক পার্থক্যসমূহের অন্যতম।
.
সপ্তম শতকে প্রচলিত প্রাচীন ইংরেজি শব্দ ‘oxa’-এর অর্থ ছিল ‘ox’, বাংলায় — ষাঁড় এবং ‘forda’ মানে ford, বাংলায়— অগভীর নদী। নদীর পাশেই ছিল গোয়াল ঘর। তবে এখানে ষাঁড় রাখা হতো বলে এর উপযুক্ত বাংলা হতে পারে, ‘গোয়াল ঘর’। অগভীর নদীকে বলা হয় ford। কথিত হয়—
এই অগভীর নদীর তীরে সংঘটিত এই ঘটনার পর ford শব্দটি থেকে fort শব্দের উদ্ভব হয়।
.
নদী-পাড়ে অবস্থিত এই গোয়ালে কেবল সেসব অবাধ্য ও হিংস্র ষাঁড়গুলোকে রাখা হতো, যেগুলো নদী পার হতে চাইত না। গোয়ালে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সাঁতরে নদী পার হওয়ার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হতো। ছবিতে দেখুন, অক্সফোর্ডের ষাঁড় কেমন ভয়ানক ছিল। ষাঁড়ের মূর্তিটি আগের মতো এখনো অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মর্যাদার প্রতীক। যা প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষার্থীদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
.
অগভীর নদীর পাশে ‘ষাঁড়ের গোয়াল ঘর’ গড়ে তোলা হয় এবং পাশে গড়ে তোলা হয় ইউনিভার্সিটি— যার নাম দেওয়া হয় ‘অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি বা ইউনিভার্সিটি অভ অক্সফোর্ড। ষাঁড়-পারাপারের জন্য নির্মিত গোয়াল ঘরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা অগভীর নদীর এক পাশে গড়ে তোলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও ষাঁড়ের ন্যায় নদী বা সমুদ্র পার হওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়ে সাগরের ওপারে পাঠিয়ে দেওয়া শুরু হয়— তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে-কোনো উপায়ে অন্যের দেশ দখল। যুক্তরাজ্যের বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ স্থাপনে ষাঁড়-পারাপার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষ ষাঁড়দের ভয়ানক ভূমিকা ছিল। ব্রিটিশ কলোনিসমূহের অধিকাংশ প্রশাসক ছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী।
.
নদীর পাশে অবস্থিত ষাঁড়ের গোয়ালে ইউনিভার্সিটি গড়ে তোলার কারণ ছিল। যুক্তরাজ্যের পণ্ডিতবর্গ বুদ্ধি করে ‘ষাঁড়ের মতো অবাধ্য, নিষ্ঠুর ও বর্বর প্রকৃতির শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য কিছু ষাঁড়কে সরিয়ে, ষাঁড়ের পাশে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে—এটিই বিশ্বখ্যাত ‘অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি’। তখন এই ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সমুদ্র পারাপারের জন্য প্রশিক্ষণরত ষাঁড় বলে উপহাস করা হতো। কারণ, তাদের আচরণ ছিল ষাঁড়ের মতো বেপরোয়া। এবং অধ্যয়ন শেষে তাদের কাজও ছিল ষাঁড়ের মতো নদী/সমুদ্র পার হয়ে জোরপূর্বক অন্যের সম্পদ এবং দেশ দখল করা। অনেকে নাকি এখনো ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ষাঁড়ের গন্ধ খুঁজে পান।
.
প্রথম থেকে বিংশ শতক অবধি অক্সফোর্ড থেকে সনদপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা নিষ্ঠুর এবং ‘ষাঁড়-প্রকৃতির ছিল। তাই ষাঁড়গিরির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ দখল এবং শাসন করার জন্য রাজা-রানি তাদের সমুদ্রের ওপারে পাঠিয়ে দিতেন। সেখানে তারা হিংস্র জানোয়ারের মতো সহিংস উল্লাসে স্বদেশিদের উৎখাত করে শাসনের নামে শোষণ করতেন। ভারতবর্ষে যেসব ইংরেজ সমুদ্র পার হয়ে বড়ো বড়ো পদ নিয়ে শাসন করতে এসেছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিল ষাঁড়-পারাপার বিশ্ববিদ্যালয়ের ষাঁড়-শিক্ষার্থী।

Leave a Comment

মোস্তাফা জব্বার-এর বাংলা বানান: ভুল আর অসংগতির নজিরবিহীন নজির

ড. মোহাম্মদ আমীন
লেখক মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর কয়েক পঙ্‌ক্তির বাংলা বানানের কিছু ভুল এবং অসংগতি বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম ও প্রামাণ্য অভিধান অনুসারে চিহ্নিত করা হলো।
  • বিদায় হলেন> বিদায়গ্রহণ করলেন [ প্রচলনই শব্দের অর্থ নির্ধারণ করে। ‘বিদায় হলেন’ নেতিবাচক কথা। এর অর্থ: দূর হওয়া, গলগ্রহ থেকে মুক্তি পাওয়া, আপদ দূর হওয়া। অবাঞ্ছিত কেউ বা কোনো কিছু দূরীভূত হলে বা দূরীভূত করার ক্ষেত্রে ‘বিদায় হলেন’ লেখা হয়। এটি অনেকটা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার মতো। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা: ৯৬৮। ]
  • সাবেক রাষ্ট্রপতি> রাষ্ট্রপতি [বর্তমান রাষ্ট্রপতি বিদায় নিয়েছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি নন। বিদায়ের দিন তিনি ‘সাবেক’ হননি— বর্তমান ছিলেন। বিদায়-গ্রহণকারী ব্যক্তি পরদিন থেকে সাবেক হন।]
  • মোঃ আব্দুল হামিদ> মোঃ আবদুল হামিদ [রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেট (অতিরিক্ত সংখ্যা, বুধবার, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৮; প্রজ্ঞাপন: ২৫ শে মাঘ ১৪২৪/০৭, ফেব্রুয়ারি ২০১৮) অনুযায়ী তাঁর প্রকৃত নাম ‘মোঃ আবদুল হামিদ’। বঙ্গভবনে কার্যকালীন দেখতাম, তিনি এই নাম লিখতেন। তাঁর লেখা ‘আমার জীবননীতি আমার রাজনীতি’ গ্রন্থেও লেখা হয়েছে, “মোঃ আবদুল হামিদ। ]
  • কর্মকর্তা কর্মচারীরা> কর্মকর্তা-কর্মচারী [প্রথমে লেখা হয়েছে ‘সকল স্তরের’ এটি বহুবচনবাচক পদবন্ধ। ‘কর্মকর্তা কর্মচারী’ কথাটিও বহুবচনবাচক। বাংলায় একই বাক্যে একই পদের জন্য একাধিক বহুবচনবাচক পদ পরিহার্য।]
  • তাকে> তাঁকে [ এই বিশেষণে সম্মানসূচক চন্দ্রবিন্দু সমীচীন ছিল। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী।]
  • বিদায়> বিদায়ি/বিদায়কালীন [‘বিদায়’ অশুদ্ধ নয়। তবে আলোচ্য বাক্য বিবেচনায় এখানে শব্দটির অশুদ্ধ প্রয়োগ ঘটেছে।]
  • সম্বর্ধনা> সংবর্ধনা [ সংবর্ধন+আ= সংবর্ধনা; বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা: ১২৬৭]
  • বিদায় সম্বর্ধনা> বিদায়ি সংবর্ধনা/বিদায়কালীন সংবর্ধনা [‘বিদায় সংবর্ধনা’ মানে ‘সংবর্ধনা’-কে বিতাড়ন করা। এটি হাস্যকর। দেখুন: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা: ৯৬৮। আমি হলে শুদ্ধ ‘সংবর্ধনা’ লিখতাম। এখানে ‘বিদায়’ অপরিহার্য ছিল না। কারণ, অনুষ্ঠানটাই বিদায় উপলক্ষ্যে আয়োজিত।]
  • প্রদান করে> প্রদান করেন/করলেন [মানিক্রিয়া (করেন) অপরিহার্য ছিল।]
  • হাওরের> হাওড়ের [(বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান,পৃষ্ঠা: ১৩৮৭); এটি মুন্ডারি হতে আগত দেশি শব্দ।]

Leave a Comment

খারেজি মাদ্রাসা, খারিজ ও খারিজি, খারেজিন, ওয়াহাবি, মাদ্রাসা, দারুল উলুম মাদ্রাসা; আলেম বনাম জাহেল, আলেম হওয়ার শর্ত

ড. মোহাম্মদ আমীন

খারেজি মাদ্রাসা, খারিজ ও খারিজি, ওয়াহাবি, মাদ্রাসা, দারুল উলুম মাদ্রাসা; আলেম বনাম জাহেল, আলেম হওয়ার শর্ত

খারেজি মাদ্রাসা: খরেজি মাদ্রাসা কাকে বলে? আরবি ‘খারেজ’ ও ‘মাদ্রাসা’ মিলে ‘খারেজি মাদ্রাসা’ বাগ্‌ভঙ্গিটি গঠিত। অর্থ (বিশেষণে) সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার বহির্ভূত ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠ্যসূচি অনুসারে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

খারজি ও খারিজি: মোহাম্মদ হারুন রশিদের সংকলন সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি হতে প্রকাশিত `বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ব্যবহৃত বিদেশি শব্দের অভিধান’ গ্রন্থের ১৪১ পৃষ্ঠায় `খারিজ’ ও `খারিজি’ শব্দের যে অর্থ/সংজ্ঞার্থ প্রদান করা হয়েছে তা নিচে দেওয়া হলো।ওই গ্রন্থ বলছে: ‘খারিজ’ আরবি উৎসের শব্দ। অর্থ (বিশেষণে) অগ্রাহ্য; বাহির; পরিত্যক্ত; বাতিল (আমার মনে হয় তিনি হফমানের বইখানা পড়েননি, নয় একপেশে বলে খারিজ করেছেন— সৈয়দ মুজতবা আলী)। (বিশেষ্যে) পরিবর্তন, অগ্রাহ্যকরণ। একই গ্রন্থের একই পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘খারিজি’ আরবি উৎসের শব্দ। (বিশেষ্যে) ১. ইসলাম ও মুসলমানদের মূল ধারা থেকে যারা বেরিয়ে গিয়েছিল তাদের খারিজি বলা হতো। এরা হজরত আলি (রা.)-কে কিছুতেই সহ্য করতে পারত না; তাই তারা মূল ধারা থেকে বেরিয়ে গিয়ে হজরত আলি (রা.)-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে দেয়। এ বিদ্রোহী সম্প্রদায়ের হাতেই হজরত আলি (রা.) শেষ পর্যন্ত শহিদ হন। ২. হজরত আলি (রা.)-এর বিরোধী সম্প্রদায়বিশেষ।

খারেজিন:  মোহাম্মদ হারুন রশিদের সংকলন সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি হতে প্রকাশিত `বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ব্যবহৃত বিদেশি শব্দের অভিধান’ গ্রন্থের ১৪১ পৃষ্ঠায় বলা হচ্ছে, ‘খারেজিন’ আরবি ‘খারেজিন’ হতে উদ্ভূত। অর্থ (বিশেষ্যে) মুসলিম ধর্মভ্রষ্ট প্রতিষ্ঠান; ইসলামের মূলধারা থেকে বিচ্যুত সম্প্রদায় যারা হজরত আলীকে (রা.) খলিফা বলে স্বীকার করত না (রোয়ে ‘ওজ্জা হোবল’ ইবলিশ খারেজিন নজরুল ইসলাম)।

ওয়াহাবি: ‘ওয়াহাবি’ বানানটা কি সঠিক? ‘ওয়াহাবি’ অর্থ কী? বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, ‘ওয়াহাবি’ বানান সঠিক। এটি ফারসি শব্দ। বিদেশি উৎসের শব্দের বাংলা বানানে ঈ-কার পরিহার্য। বাক্যে সাধারণত বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত ‘ওয়াহাবি’ শব্দের অর্থ: ইসলাম ধর্মের সংস্কারক আবদুল ওয়াহাবের অনুসারী। ওয়াহাবি শব্দের উচ্চারণ: ও্‌আহাবি।

মাদ্রাসা: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, ‘মাদ্রাসা’ হলো ইসলাম-ধর্মসংক্রান্ত বিষয় অধ্যয়নে বা অনুশীলনে গুরুত্ব দেওয়া হয় এমন শিক্ষাকেন্দ্র বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এটি আরবি উৎসের শব্দ। উচ্চারণ /মাদ্‌রাসা/।

দারুল উলুম মাদ্রাসা: দারুল উলুম কথাটি আরবি। এর অর্থ— জ্ঞানালয়, জ্ঞানগৃহ, জ্ঞানাগার, যেখানে জ্ঞান দান করা হয়, শিক্ষা দেওয়া হয়। কথাটি দ্বারা সাধারণত ইসলামি ধর্মীয় শিক্ষালয় বোঝানো হয়। দারুল উলুম দেওবন্দ ভারতের একটি ইসলামিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইসলামি শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে কয়েকজন ইসলামি পণ্ডিত উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। দারুল উলুম অন্যান্য মাদ্রাসার অনুরূপ হলেও এতে বিশেষ পাঠ্যসূচি রয়েছে। সেলজুক সাম্রাজ্যের নিজামিয়া ইসলামিক বিদ্যালয়গুলো থেকে দারুল উলুম-এর উদ্ভব। বাংলাদেশে অবস্থিত দারুল উলুম নামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ দারুল উলুম দেওবন্দকে অনুসরণ করে থাকে।

আলেম বনাম জাহেল: আলেম হওয়ার শর্ত: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, আরবি উৎসের আলেম শব্দের প্রধান অর্থ: ইসলাম ধর্মতত্ত্বজ্ঞ। অপ্রধান অর্থ: পণ্ডিত, বিদ্বান ব্যক্তি। এখন আলেম শব্দটি ইসলাম ধর্মতত্ত্বজ্ঞ বা ইসলাম ধর্মবিষয়ক পণ্ডিত ব্যক্তি’ কথার পরিভাষা হিসেবে আভিধানিক ও প্রায়োগিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বহুল প্রচলিত। তাই বাংলায় আলেম বলতে মুখ্যত বা সাধারণত ইসলাম ধর্মতত্ত্বজ্ঞ বা ইসলাম ধর্মবিষয়ক জ্ঞানী/বিদ্বান ব্যক্তি বা পণ্ডিতকে প্রকাশ করে। অন্য কাউকে নয়। উৎস ভাষায় আলেম শব্দটির অর্থ যাই থাকুক বা যাই হোক না, বাংলায় এখন আলেম শব্দটি ইসলাম ধর্মতত্ত্বজ্ঞ, ইসলাম ধর্মবিষয়ক পণ্ডিত ব্যক্তি’ কথার পরিভাষা হিসেবে আভিধানিক ও প্রায়োগিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত, সুস্বীকৃত এবং বহুল প্রচলিত। উৎস ভাষায় আলেম শব্দের অর্থ কী বা কী ছিল তা বাংলায় বিবেচ্য নয়। এমন কোনো সুযোগও নেই। এরূপ অনেক শব্দের অর্থ বাংলা এসে নির্দিষ্ট রূপ ধারণ করেছে। মন্দির অর্থ ছিল গৃহ। এখন এর একমাত্র অর্থ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা গৃহ। কথাটি আলেম শব্দের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। 

যার জ্ঞান আছে সে জ্ঞানী। এই জ্ঞান যে বিষয়ের হোক না। কিন্তু বাংলায় আলেম বলতে কেবল ইসলাম ধর্মতত্ত্বজ্ঞ বা ইসলাম ধর্মে বিশেষজ্ঞকে বুঝায়। পাদ্রি, পুরোহিত, রাব্বি প্রমুখও জ্ঞানী। তাদের জ্ঞানী, পণ্ডিত, শাস্ত্রজ্ঞ বলা যায়, বিদ্বানা বলা যায়, কিন্তু বাংলায় আলেম শব্দের প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত অর্থ জ্ঞাপনে আলেম বলা সমীচীন হবে না। তারাও খুশি হবে না। … … … ইসলাম ধর্মতত্ত্বজ্ঞ নয়, এমন কেউ যতই উচ্চশিক্ষিত হোক না, বাংলায় তাকে কেউ আলেম বলে না, জ্ঞানী, বিদ্বান, পণ্ডিত প্রভৃতি বলে। আরবি উৎসের জাহিল বা জাহেল অর্থ (বিশেষণে) অজ্ঞ, নির্বোধ এবং (বিশেষ্যে) অশিক্ষিত ব্যক্তি। … … … এর সঙ্গে ইসলাম ধর্মে অজ্ঞ-অনজ্ঞবিষয়ক কোনো সম্পর্ক নেই। … জাহেল শব্দের উৎস অর্থ কী ছিল বা কী আছে তা বিবেচ্য নয়। এখন এটি বাংলা শব্দ। তাই বাংলা অর্থই বিবেচ্য। অভিধানে প্রদত্ত অর্থানুসারে, যে কেউ জাহিল বা জাহেল হতে পারে। তবে ইসলাম ধর্মবিষয়ক জ্ঞান না থাকলে বা ইসলাম ধর্মতত্ত্বজ্ঞ না হলে তাকে সাধারণ প্রচলিত অর্থে আলেম বলা যায় না। তাকে বিদ্বান, পণ্ডিত, জ্ঞানী বলা যায়। অর্থাৎ সকল আলেম, জ্ঞানী/বিদ্বান/পণ্ডিত , কিন্তু সকল জ্ঞানী/বিদ্বান/পণ্ডিত, আলেম নয়।
.
সূত্র: বাংলা একাডমি আধুনিক বাংলা অভিধান।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ব্যবহৃত বিদেশি শব্দের অভিধান, সংকলন ও সম্পাদনায় মোহাম্মদ হারুন রশিদ; প্রকাশক: বাংলা একাডেমি।
সহায়ক গ্রন্থ: #subach

Leave a Comment

You cannot copy content of this page


CasibomCasibom