সাহিত্য-প্রবাদ অভিজ্ঞতার আলোকে লোকমুখে সৃষ্ট বাণী। বাণী বা প্রবাদের জন্যই ভাষা এবং পরবর্তীকালে সাহিত্যের সৃষ্টি। তাই ভাষা সৃষ্টির প্রথম বাণী বা কথাটিই ছিল প্রবাদ। ভাষা সৃষ্টির সূচনায় কথাই ছিল সাহিত্য এবং সাহিত্যই ছিল কথা। সংগত কারণে প্রথম সাহিত্য-প্রবাদ কোনটি তা জানা যায় না। বাংলা ভাষার জন্য কথাটি আরো কঠিনভাবে সত্য। আর্য আগমনের অনেক পূর্ব হতে বিদ্যমান আদি বাংলা ভাষার অস্তিত্ব, আর্য আগমনের পর হতে বিলুপ্ত হতে শুরু করে। ভারতবর্ষের অধিবাসীর মুখের ভাষা বাংলাকে সংস্কার করে গড়ে তোলা হয় সংস্কৃত। পরবর্তীকালে সংস্কৃতপ্রেমীদের কাছে বাংলায় হয়ে যায় সংস্কৃতের জননী/বোন। কলম আর ক্ষমতা থাকলে কী না হয়! যাই হোক, পণ্ডিতবর্গের মতে, ‘বৌদ্ধগান ও দোহা’য় ব্যবহৃত প্রবাদগুলোই বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্য প্রবাদ। এরূপ কয়েকটি প্রবাদ হলো :
১. হাথেরে কাঙ্কাণ মা লোউ দাপণ। (৩২ নম্বর পদ)। অর্থ: হাতের কঙ্কণ আছে কি নেই তা দেখানোর জন্য দর্পণের দিকে না তাকানো।
২. আপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী। (৬ নম্বর পদ)। অর্থ: হরিণ তার নিজের মাংসের জন্যই নিজের শত্রুস্বরূপ।
‘দাদখানি’ অতি উৎকৃষ্ট মানের এক প্রকার চাল। চালটির নাম কীভাবে দাদখানি হলো? কথিত হয়, বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খান (১৫৭৩-১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দ)-এর আমলে বঙ্গদেশে এ চালের চাষাবাদ শুরু হয়। সুলতানের দরবারে চালটির বেশ চাহিদা ছিল। দাউদ খান নিজেও চালটি পছন্দ করতেন। তাঁর প্রাত্যহিক খাবার টেবিলে এই চালের ভাত আবশ্যিকভাবে থাকত। ফলে এর নাম হয়ে যায় দাউদখানি চাল। যার অপভ্রংশ দাদখানি চাল। শিশুকালে পড়া কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকার (১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দ ; ১২ কার্তিক ১২৭৩ বঙ্গাব্দ – ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দ ; ১২ আষাঢ় ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ) এর ‘কাজেরছেলে’ কবিতায় বর্ণিত ‘দাদখানি চাল’ এখনও স্মৃতিকে উদ্বেল করে তোলে।
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ। পথে হেঁটে চলি, মনে মনে বলি, পাছে হয় ভুল; ভুল যদি হয়, মা তবে নিশ্চয়, ছিঁড়ে দেবে চুল।
ওই তো ওখানে ঘুড়ি ধরে টানে, ঘোষদের ননী; আমি যদি পাই, তা হলে উড়াই আকাশে এখনি! দাদখানি তেল, ডিম-ভরা বেল, দুটা পাকা দৈ, সরিষার চাল, চিনি-পাতা ডাল, মুসুরির কৈ!
এসেছি দোকানে-কিনি এই খানে, যত কিছু পাই; মা যাহা বলেছে, ঠিক মনে আছে, তাতে ভুল নাই! দাদখানি বেল, মুসুরির তেল, সরিষার কৈ, চিনি-পাতা চাল, দুটা পাকা ডাল, ডিম ভরা দৈ।
সূত্র: বাংলা সাহিত্য ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহা, ড. মোহাম্মদ আমীন, আগামী প্রকাশনী।
‘বিপদ হতে মুক্তি বা পরিত্রাণ পেয়েছে’ এমন অর্থ প্রকাশে ‘বিপন্মুক্ত’ ও ‘বিপদমুক্ত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘বিপন্মুক্ত’ শব্দের নির্মাণচিত্র হলো : বিপদ্+উন্মুক্ত = বিপন্মুক্ত। যার অর্থ বিপদ হতে মুক্তি বা পরিত্রাণ পেয়েছে এমন। যেমন : ঘূর্ণিঝড় দূরে সরে গেছে, উপকূলীয় অঞ্চল এখন বিপন্মুক্ত। ডাক্তার বললেন, রোগি এখন বিপন্মুক্ত।
‘বিপদমুক্ত’ শব্দটি ‘বিপন্মুক্ত’ শব্দের পরিবর্তে অভিন্ন অর্থ প্রকাশে ব্যবহার করা হলেও ব্যাকরণ এবং বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, ‘বিপন্মুক্ত’ শব্দটিই শুদ্ধ
এবং প্রমিত। তবে বাংলায় ‘বিপন্মুক্ত’ শব্দে দ্যোতিত অর্থ প্রকাশে ‘বিপদমুক্ত’ শব্দটির বহুল প্রচলন লক্ষণীয়। অথচ, বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘বিপদমুক্ত’ শব্দটিকে স্থানই দেওয়া হয়নি। এতে বোঝা যায়, বাংলা একাডেমির কাছে ব্যাকরণই প্রধান, ভাষাভাষী নয়। শব্দের জনপ্রিয়তা ও প্রচলন উপেক্ষাকারী এমন ব্যাকরণ নির্ভর অভিধান, অভিধান নয়, অবিধান। এমন অবিধান বেশি দিন টিকে না।
হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়-সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির রচিত অভিধানেও ‘বিপদমুক্ত’ শব্দটি পাওয়া যায় না। বৈয়াকরণদের মতে, ‘বিপদমুক্ত’ শব্দটি আদৌ বিপন্মুক্ত নয়। তাঁদের মতে, শব্দটির জন্মের ঠিক নেই। এটি অসিদ্ধ এবং প্রতিবন্ধী।
প্রতিবন্ধী হোক বা অসিদ্ধ হোক, ‘বিপদমুক্ত’ শব্দটি ‘বিপন্মুক্ত’ শব্দকে বিতাড়িত করে বিপদ হতে মুক্ত হয়ে বাংলার সর্বত্র হরদম ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রসার এত ব্যাপক যে, অসিদ্ধ ‘বিপদমুক্ত’ শব্দের কাছে সিদ্ধ ‘বিপন্মুক্ত’ শব্দটি আসলেই মারাত্মকভাবে বিপদগ্রস্ত। সংস্কৃত ভাষার অনুকরণে নির্মিত বাংলা ব্যাকরণের নিয়মানুসারে ‘বিপদমুক্ত’ শব্দ অসিদ্ধ হতে পারে, কিন্তু বাংলা ভাষার শব্দ হিসেবে ‘বিপদমুক্ত’ শব্দটি সম্পূর্ণ সিদ্ধ এবং বাংলায় এর জন্মও যথাযথ।
অধুনা ‘বিপদমুক্ত’ শব্দটির প্রচলন এত ব্যাপক এবং জনপ্রিয়তা এত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে, যে শব্দটির প্রসার ও ব্যবহার রোধ করার সাধ্য কারো নেই। তাই বাংলা একাডেমির উচিত, সংস্কৃত অনুকরণে সিদ্ধ-অসিদ্ধ বিবেচনা না করে ‘বিপন্মুক্ত’ শব্দের পাশাপাশি বাংলা শব্দ হিসেবে ‘বিপদমুক্ত’ শব্দকেও অভিধানে সসম্মানে স্থান দেওয়া। নইলে একাডেমির অভিধান কেবল ‘বিপন্মুক্ত’ নিয়ে জনপ্রিয়তার অভাবে নিজেই বিপদগ্রস্ত হয়ে থাকবে সবসময়।
অভিধান দোকানের মতো। দোকানের পণ্য দোকানদারের ভোগের জন্য নয়, সাধারণের ভোগের জন্য। সাধারণ জনগণ যে দোকানের পণ্য বেশি ক্রয় করবে, সে দোকান ও দোকানদার তত বেশি সফল হবে। কিন্তু সাধারণ জনগণ যদি দোকানে তাদের প্রত্যাশিত পণ্য না-পায় তাহলে ওই দোকানের পণ্য কেবল দোকানদারের ভোগ্যপণ্য হয়ে যাবে। ফলে অচিরে শেষ হয়ে যাবে দোকান, দেউলিয়া হয়ে যাবে দোকানদার।
উৎস: ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।
মাতারি কী? মাতারি একটি আঞ্চলিক শব্দ। বাংলাএকাডেমীবাংলাদেশেরআঞ্চলিকভাষারঅভিধানমতে এটি কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ, বগুড়া ও ঢাকা অঞ্চলের শব্দ। তবে এসব অঞ্চল ছাড়াও বাংলাদশের আরো অনেক অঞ্চল; ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের বরাক উপত্যাকার বিভিন্ন এলাকায় মাতারি শব্দটি প্রায় একই অর্থে বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রচলিত আছে। এটি একটি প্রাচীন শব্দ। মৌর্য ও গুপ্ত যুগে মাতারি শব্দটি মাতা বা সংসারের প্রধান, সমাজের নেত্রী, কত্রী, পরিচালক, শ্রেষ্ঠ, নির্ভরক প্রভৃতি অর্থ দ্যোতিত করার জন্য ব্যবহৃত হতো। গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, বাংলার প্রাচীন যুগ থেকে মাতারি শব্দটি দিয়ে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার চালক বা প্রধান নারীকে নির্দেশ করা হতো। তবে শব্দটি এখন আগের সে অর্থ হারিয়ে ফেলেছে। দেখা যাক, কেন সে তার আদি অর্থ হারিয়েছে।
অনেকে মনে করেন, মাতারি শব্দটি কেবল তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত একটি নেতিবাচক শব্দ। কারো কারো মতে, এটি একটি গালি, অনেকে এটাকে গালি হিসেবে
ব্যবহারও করে থাকেন। তাই সাধারণভাবে ‘মাতারি’ শব্দটিকে তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। আসলে বিষয়টি আদৌ তা নয়। মাতা শব্দের অর্থ মা, জননী, গর্ভধারিণী, মাতৃ বা কন্যাস্থানীয় নারী এবং মাতারি হচ্ছে ‘মাতা’-এর ধারক, সংসারের নেত্রী; মাতাঋষি। বৈয়াকরণদের অভিমত, মাতারি শব্দটি উপমহাদেশে আর্য আগমনের সময় প্রচলিত হয়েছে। ভাষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাতারি শব্দটি ফারসি মাদর এবং ইংরেজি মাদার থেকে অভিন্ন অর্থ নিয়ে বা অনুরূপ মর্যাদা নিয়ে আগত।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে, মাতা শব্দের সঙ্গে রি যুক্ত হয়ে মাতারি (মাতা+রি) শব্দের উদ্ভব।এই রি হচ্ছে ঋষি–রি। মাতা থেকে থেকে উদ্ভূত ‘মাতারি’ শব্দের অর্থ মাতা-ঋ; মাতা-ঋষি। মাতা শব্দ থেকে উদ্ভূত বলে উৎসকালে মাতারি (মাতাঋ) অতি সম্মানজনক শব্দ ছিল। বাংলা একাডেমী বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানমতে, মাতারি শব্দের অর্থ বয়স্ক স্ত্রীলোক, ঝি-চাকরানি, মা, চাচি, স্থানীয় মহিলা প্রভৃতি।বর্তমানে সাধারণ্যে শব্দটি যতই তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হোক না কেন, অভিধানে এখনো মাতারি শব্দটি ‘মা’ অর্থ নির্দেশ করে। অধিকন্তু, আভিধানিক অর্থসমূহের কোনোটিই নেতিবাচক নয়, যদিও মাতারি শব্দকে নেতিবাচক মনে করা হয়। এমন মনে করার অন্যতম কারণ হচ্ছে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের পতন এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উত্থান।
মাতারি শব্দের নিহিত ও আদি অর্থ কী? মাতার দায়িত্বে যিনি নিয়োজিত থাকেন তিনিই মাতারি। মাতার ক্রিয়া, কৃ বা রি বা ঋষির কর্ম যে নারী বা রি(স্ত্রী)-এর ওপর ন্যস্ত তিনিই মাতারি। সেক্ষেত্রে একজন নারী ‘মাতা’ না হয়েও মাতারি হতে পারেন। মাদার তেরেসা একজন মাতারি। তিনি কাজ কাজ করতেন, সেবা করতেন মানুষের এবং পশুপাখির- যেমন করেন বাড়ির ঝি-চাকরানি।বাবা না হয়েও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন পুরুষ হতে পারেন সংসারের কর্তা। যেমন : আমার পিতামহ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তিনিই ছিলেন সংসারের কর্তা। যদিও সংসারের প্রধান অর্থদাতা ছিলেন বাবা। সেকালে সাধারণভাবে ‘নারী’ই হতেন সংসারের প্রধান, সমাজের সর্দার, সংসারের রক্ষক, সবার নির্ভরক। সুতরাং, মাতারি কেবল মাতা বা জননী নন, তারও অধিক।
প্রাচীন বাংলায় আদিবাসীদের পরিবার ছিল মাতৃপ্রধান, এখনো উপজাতীয় সমাজে তা দেখা যায়। তখন মা-ই ছিললেন সংসারের সর্বেসর্বা। সংসারের ঋ বা ঋষি; সংসারের সব কাজই মাকে করতে হতো। সংগত কারণে মাতাই ছিলেন মাতারি, মাতাই ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে সম্মানিত নারী, তাই তাকে বলা হতো মাতাঋষি বা মাতারি। পরবর্তীকালে আদিম মাতৃপ্রধান পরিবার ব্যবস্থার বিবর্তন এবং পিতৃপ্রধান সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করলে মাতারি শব্দটি তার আদি সম্মানজনক অর্থ হারাতে থাকে।
এ অবস্থায়, পিতৃপ্রধান সমাজ ব্যবস্থার প্রারম্ভিক প্রসারকালে পুরুষগণ নিজেদের শ্রেষ্ঠ হিসেবে উপস্থাপন করে তাদের পূর্বতন নেতা ‘মাতারি’কে প্রতিহিংসাবশত ঝি-চাকরানি প্রভৃতি তুচ্ছার্থে ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে ‘মাতারি’ শ্রেষ্ঠ হয়েও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের ঈর্ষায় পড়ে তার শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়ে ফেলে।
উৎস: বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদআমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সলি.
বাংলার সবচেয়ে মর্যাদাশীল বর্ণ কোনটি? ‘বর্গীয়–ব’। কেন? কারণ, বাংলা ও বাংলাদেশ নামের বানানের প্রথম অক্ষর হলো ‘বর্গীয়–ব’। অধিকন্তু, মানুষের জন্মদাতা হিসেবে পরিচিত ‘বাবা’ নামের সম্বোধন-শব্দটির দুটি বর্ণই ‘বর্গীয়–ব’। কোনো বর্ণের মর্যাদাশীল হিসেবে প্রথম স্থান অধিকার করার জন্য— এর চেয়ে বেশি আর কী লাগে? ‘বর্গীয়–ব’ বর্ণের অবিকল চেহারার আর একটি পৃথক বর্ণ হচ্ছে ‘অন্তঃস্থ–ব’। উভয় বর্ণের চেহারা ও নামে মিল থাকলেও উচ্চারণ, আচরণ এবং প্রায়োগিক বিষয়ে কোনো মিল নেই। আলোচ্য প্রবন্ধে এই দুটি বর্ণের পার্থক্য বা অমিলগুলো কী তা আলোচনা করা হবে।
‘বর্গীয়–ব’ প-বর্গের (প ফ ব ভ ম) অন্তর্ভুক্ত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলা বর্ণ। আমাদের দেশের (বাংলাদেশ) নামের প্রথম অক্ষর হিসেবে এর একটি আলাদা মর্যাদা রয়েছে। অন্যদিকে, ‘বর্গীয়-ব’-এর অনুরূপ আকৃতির ‘অন্তঃস্থ-ব’ একটি পরাশ্রয়ী বর্ণ। বাংলা বর্ণমালার অন্তঃস্থ-বর্ণ সারিতে (য র ল ব শ ) এক সময় ‘অন্তঃস্থ-ব’ বর্ণটির অবস্থান ছিল, এখন নেই। বর্ণমালায় না-থাকলেও বাংলা শব্দগঠনে ‘অন্তঃস্থ-ব’-এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়। এবার উভয় বর্ণের প্রায়োগিক ও উচ্চারণগত পার্থক্য কী তা দেখা যাক:
‘বর্গীয়–ব’ স্বাধীন সত্তাবিশিষ্ট স্বয়ংসম্পূর্ণ বর্ণ। এর ব্যবহার যেমন ব্যাপক তেমনি বৈচিত্র্যময়। এটি বাক্যে স্বাধীনভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, আবার অন্য বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয়েও ব্যবহৃত হয়। যেমন : বর, আবার, আবহাওয়া, আব্বা, উদ্বেল, অব্যয়, কম্বল, ব্যথা, ব্যাকরণ, বুলবুলি, বাংলাদেশ ইত্যাদি। ‘অন্তঃস্থ–ব’ স্বাধীন বর্ণ নয়। স্বাধীন নয় বলে এটি কোনো স্বাধীন সত্তারও অধিকারী নয়। বর্ণটি কেবল পরাশ্রয়ী হিসেবে অন্য বর্ণের আশ্রয় নিয়ে বাক্যে ব্যবহৃত হয়। যেমন : দ্বিতীয়, অদ্বিতীয়, নিঃস্ব, স্বাধীনতা , স্বদেশি, স্বাগত, স্বজাতি প্রভৃতি।
‘বর্গীয়–ব’ সর্বত্র এবং সর্বাবস্থায় সাধারণত তার মূল উচ্চারণ অবিকৃত রেখে ব্যবহৃত হয়। এটি বর্ণচোরা নয়। ‘বর্গীয়–ব’ স্বাধীনভাবেও ব্যবহৃত হয়; আবার, অন্য বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুক্তব্যঞ্জনরূপেও ব্যবহৃত হয়। যেমন : বল, বারবার, তবলা, তাণ্ডব, উদ্যাপন, উদ্বোধন, কম্বল, কলম্বো, বল, বিহ্বল, অবিলম্বে প্রভৃতি। এসব শব্দে ব্যবহৃত ‘ব’ হলো ‘অন্তঃস্থ–ব’। কারণ, এখানে বর্ণটি তার মূল উচ্চারণ অবিকৃত রেখে স্বাধীন সত্তা নিয়ে বিরাজমান। আবার উৎ, দিক্, বাক্, ঋক্, ইত্যাদি ব্যঞ্জন ধ্বনির পরে ব-ফলা এলে সেই ব উচ্চারণ হয়। এই ব হচ্ছে ‘বর্গীয়–ব’। যেমন : উদ্বেগ [উদ্ বেগ্], উদ্বোধন [উদ্ বোধন্], উদ্বাস্তু [উদ্ বাস্ তু], ঋগ্বেদ [ঋগ্ বেদ্], দিগ্বিজয় [দিগ্ বিজয়], দিগ্বিদিক [দিগ্ বিদিক্], দিগ্বলয় [দিগ্ বলয়], ইত্যাদি।
‘অন্তঃস্থ–ব’ স্বাধীন সত্তাহীন। তাই এটি সবসময় অন্য বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শব্দে ব্যবহৃত হয়। এর উচ্চারণও সুনির্দিষ্ট নয়। শব্দে অবস্থানের ওপর তার উচ্চারণ নির্ভর করে।ব-হিসেবে অনুচ্চারিত ব-ফলাই সাধারণত অন্তঃস্থ-য। ‘অন্তঃস্থ–ব’ শব্দের প্রথম বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হলে সে অনুচ্চারিত থেকে যায়। যেমন : ‘শ্বাপদ’ (শাপদ) দ্বিজ (দিজো), স্বভাব্ (শভাব), স্বয়ং (শয়োঙ্) প্রভৃতি। আবার, শব্দের প্রথমে যুক্ত হলে অনুচ্চারিত থেকে যায় : যেমন : স্বকুল (শকুল), স্বচক্ষে (শচোক্খে), স্বত(শতো), স্বামী (শামি) প্রভৃতি। তেমনি- ক্বচিৎ, জ্বর, জ্বালানি, ত্বক, ত্বরান্বিত, দ্বি, দ্বিজ, দ্বারা, ধ্বংস, ধ্বনি, ধ্বজা, শ্বাপদ, শ্বৈত্য, শ্বেত, স্বপ্ন, স্বচ্ছন্দ, স্বভাব, স্বামী, স্বস্তি, স্বীকার, স্বাক্ষর, স্বল্প, ইত্যাদি।
কোনো শব্দে প্রথম বর্ণটি ব-ফলাযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ হলে, ওই ব-ফলার উচ্চারণ কীভাবে হয় বা হয় না সে সম্পর্কে বাংলা একাডেমি বাঙলা উচ্চারণ অভিধানে [পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৯৯)-এর নবম পুনর্মুদ্রণ (২০১৬)] এরূপ নির্দেশনা বর্ণিত হয়েছে : “পদের আদ্য ব্যঞ্জনবর্ণ ‘ব’-ফলা সংযুক্ত হলে সাধারণত সে ব-ফলার কোনো উচ্চারণ হয় না (তবে আদি বর্ণটির উচ্চারণে সামান্য ঝোঁক বা শ্বাসাঘাত পড়ে থাকে)। যথা : স্বাধিকার (শাধিকার্), স্বদেশ (শদেশ্), জ্বালা (জালা), ত্বক (তক্), শ্বাপদ (শাপদ্), শ্বাস (শাশ্), ধ্বনি (ধোনি), স্বামি (শামি), স্বাগত (শাগতো), * সংস্কৃতে এসব অন্তঃস্থ ‘ব্’-এর উচ্চারণ ছিল নির্ধারিত (যথা : সুয়াধিকার্, সুয়দেশ্, তুয়ক্, শুয়াশ্ ইত্যাদি)।”
‘অন্তঃস্থ–ব’ যখন শব্দের মধ্যে বা অন্ত্যে কোনো বর্ণে আশ্রয় গ্রহণ করে, তখন ওই আশ্রয়দাতা বর্ণকে দ্বিত্ব দান করে। যেমন : দ্বিত্ব /দিত্তো/’ অন্বর্থনামা /অন্নর্থোনামা/, বিশ্ব/বিশ্শো/, বিশ্বাস’ (বিশ্শাশ), ‘অশ্ব’ (অশশো) প্রভৃতি। কিন্তু বর্গীয়-ব’ সবসময় এবং সর্বত্র নিজের উচ্চারণ অবিকল রাখে। অর্থাৎ আদ্য বর্ণের সাথে যুক্ত ‘অন্তঃস্থ–ব‘ কোনো ‘দ্বিত্ব’ সৃষ্টি করে না, কিন্তু অন্যত্র যুক্ত হলে দ্বিত্ব সৃষ্টি করে।অর্থাৎ শব্দের প্রথমে ব-ফলার উচ্চারণ না থাকলেও শব্দের মাঝে বা শেষে সাধারণত ব-ফলার পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনটির দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়। যেমন, স্বাভাবিক [শাভাবিক্] শব্দে ব-ফলার উচ্চারণ না থাকলেও অস্বাভাবিক [অশ্ শাভাবিক্] উচ্চারণে ব-ফলার পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব হচ্ছে। তেমনি, স্বীকার [শিকার] কিন্তু অস্বীকার [অশ্ শিকার], ধ্বংস [ধংশ] কিন্তু বিধ্বংসী [বিদ্ ধংশি], ধ্বজা [ধজা] কিন্তু জয়ধ্বজা [জয়োদ্ ধজা], স্বাগতম [শাগতম্] কিন্তু সুস্বাগতম [শুশ্ শাগতম্], দ্বীপ [দিপ্] কিন্তু বদ্বীপ বদ্ দিপ্], বিশ্বাস [বিশ্ শাশ্], নিশ্বাস [নিশ্ শাশ্], চত্বর [চত্ তর্], জব্বর [জব্ বর্], পক্ব [পক্ কো], বিশ্ব [বিশ্ শো], বিদ্বেষ [বিদ্ দেশ্], বিদ্বান [বিদ্ দান্] ইত্যাদি।শব্দের ভেতর হ এর সঙ্গে ব-ফলা এলে হ এবং ব কোনটাই উচ্চারণ হয় না। হ-এর পরিবর্তে আসে ও আর ব মহাপ্রাণতা লাভ করে। যেমন, বিহ্বল [বিওভল্], আহ্বান [আওভান্], জিহ্বা [জিওভা], ইত্যাদি।
উৎস: ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।
সংস্কৃত ‘শেষ’ শব্দের অর্থ বিশেষ্যে — সমাপ্তি, অবসান, ধ্বংস, বিনাশ, সীমা, নিষ্পত্তি এবং বিশেষণে — সমাপ্ত, বিনষ্ট, বিধ্বস্ত, অন্তিম, চরম, চূড়ান্ত প্রভৃতি; ইংরেজিতে যাকে বলা যায় finish। বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত ‘সমাপ্ত’ শব্দের অর্থ শেষ, নিষ্পন্ন, সম্পূর্ণ, বিগত, অতীত প্রভৃতি; ইংরেজিতে বলা যায়—end। আবার বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘সমাপ্তি’ শব্দের অর্থ— সমাপন, অবসান প্রভৃতি।
অভিধার্থ বিবেচনায় ‘শেষ’, ‘সমাপ্ত’ ও ‘সমাপ্তি’ পরস্পর সমার্থক মনে হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রায়োগিক প্রকাশ-বোধ ভিন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয় মনে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে ‘সমাপ্ত’ বা ‘সমাপ্তি’ শব্দের স্থলে ‘শেষ’ লেখা শ্রুতিমধুর মনে হয় না, মনে হয় না অর্থবহ। আবার ঘটতে পারে এর উলটো। তাই শব্দ তিনটির প্রয়োগে উদ্দেশ্য-সাপেক্ষে সতর্কতা আবশ্যক।
‘শেষ’ সাধারণত ঋণাত্মক বিষয় প্রকাশে অধিক ব্যবহৃত হয়। যেমন : “রোগ আমার জীবনটা শেষ করে দিল।” সমাপ্ত বা সমাপ্তি ইতিবাচক বিষয় প্রকাশে অধিক ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে শেষ ও সমাপ্ত উভয় শব্দ অভিন্ন অর্থ বহন করে। যেমন :“ ক্লাস সমাপ্ত/ শেষ করে বাড়ি যাব।” অবাঞ্ছিত বিষয়ের অবসান প্রকাশে ‘শেষ’ শব্দটি অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়। যেমন : “দুঃখের শেষ, সুখের শুরু।” অনেক সময় ‘শেষ’ শব্দটি ইতিবাচক বা সাধারণ বিষয় প্রকাশেও ব্যবহৃত হয়। যেমন : “পরীক্ষা শেষ হলো, যেন নরক জীবনের সমাপ্তি ঘটল।” সাধারণভাবে ‘শেষ’ এবং ‘সমাপ্ত’ ও ‘সমাপ্তি’ যেখানে একই অর্থ বহন করে সেখানে তুলনামূলকভাবে ছোটো ‘শেষ’ শব্দটির ব্যবহার শ্রুতিমধুর হয়। যেমন : “পরীক্ষাশেষহলেবাড়িযাব।” — এ বাক্যটি “পরীক্ষাসমাপ্তকরে/হলেবাড়িযাব।” —বাক্যের চেয়ে শ্রুতিমধুর মনে হয়।
শব্দগুলোর প্রায়োগিক পার্থক্য নিচে আরও কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করা হলো:
১. শেষ: জাফর সাত বছর প্রেম করার পর বিয়ে করলেন। তাদের দাম্পত্য জীবন নরকময়। এক্ষেত্রে বলা যায়- জাফরের সাত বছরের প্রেম বিয়ের পর শেষ হয়ে গেল। অর্থাৎ জাফর শেষ।
২. সমাপ্তি: জাফর সাত বছর প্রেম করার পর বিয়ে করলেন। তাদের দাম্পত্য জীবন স্বর্গময়। এক্ষেত্রে বলা যায়- বিয়ের মাধ্যমে জাফর সাত বছরের প্রেমের সমাপ্তি ঘটালেন। অর্থাৎ জাফর সফল।
৩. সমাপ্ত: ছাত্রজীবন সমাপ্ত হওয়ার পর জাফর কর্মজীবনে প্রবেশ করলেন।
বাক্যে ক্রিয়াপদের সঙ্গে অন্যান্য পদের যে সম্পর্ক থাকে, তাকে কারক বলে। কারক প্রধানত ছয় প্রকার। ছয় প্রকার কারকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং নির্ণয়ের সহজ কৌশল নিয়ে এই ছোটো লেখা:
১. কর্তৃকারক: বাক্যস্থিত যে বিশেষ্য বা সর্বনাম পদ ক্রিয়া সম্পন্ন করে, তাকে কর্তৃকারক বলে। নির্ণয়ের কৌশল: ক্রিয়াকে ‘কে’ বা ‘কারা’ যোগে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায়, তা-ই হচ্ছে কর্তৃকারক। যেমন: ক. ছোটো বন্ধু বার্তা পড়ে। কে পড়ে? ছোটো বন্ধু— কর্তৃকারক। খ. আমরা গান গাই। কারা গায়? আমরা— কর্তৃকারক।
২. কর্মকারক: যাকে আশ্রয় করে কর্তা ক্রিয়া সম্পন্ন করে, তাকে কর্মকারক বলে। নির্ণয়ের কৌশল: ক্রিয়াকে ‘কী’ বা ‘কাকে’ কিংবা ‘কার’ যোগে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায়, তা-ই হচ্ছে কর্মকারক। যেমন:
ক. তাহাসিন ছবি আঁকছে। কী আঁকছে? ছবি— কর্মকারক। খ. ছাফিয়াকে বকো না। কাকে বকো না? ছাফিয়াকে— কর্মকারক। গ. ধোপাকে কাপড় দাও। কাকে দাও? ধোপাকে— কর্মকারক। ঘ. টমের দেখা পেলাম না। কার দেখা পেলাম না? টমের— কর্মকারক
৩. করণকারক: যে যন্ত্র বা উপকরণ কিংবা মাধ্যমের সাহায্যে ক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তাকে করণ কারক বলে। নির্ণয়ের কৌশল: ক্রিয়াকে ‘কী/কীসের দিয়ে/দ্বারা’ বা ‘কী উপায়ে’ যোগে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায়, তা-ই হচ্ছে করণ কারক। যেমন: ক. আমি কলম দিয়ে লিখি। কী দিয়ে লিখি? কলম— করণ কারক। খ. পরিশ্রমে সফলতা মিলে। কীসের দ্বারা সফলতা মিলে? পরিশ্রম— করণ কারক। গ. টাকায় সব মেলে। কীসের দ্বারা সব মেলে? টাকায়— করণ কারক। ঘ. আলোয় অন্ধকার দূর হয়। কীসের দ্বারা অন্ধকার দূর হয়/কীসের দ্বারা দূর হয়? আলোর— করণ কারক।
৪. সম্প্রদানকারক: যখন কাউকে কোনো কিছু স্বত্ব ত্যাগ করে দান করা হয় কিংবা নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করা হয়, তখন ঐ ব্যক্তিকে(যাকে দান বা সাহায্য করা হয়) সম্প্রদান কারক বলে। যেমন: দরিদ্রকে খাদ্য দাও। দরিদ্রকে খাদ্য দিলে তা ফেরত পাওয়ার আশায় দেওয়া যাবে না, স্বত্ব ত্যাগ করে দিতে হবে। তাই এখানে ‘দরিদ্রকে’ হচ্ছে সম্প্রদান করক।
৫. অপাদান কারক: বাক্যে যা থেকে কোনো কিছু গৃহীত, বিচ্যুত, জাত, বিরত, আরম্ভ, দূরীভূত, রক্ষিত ইত্যাদি বোঝায় অথবা যাকে দেখে কেউ ভয় পায়, তা-ই হচ্ছে অপাদান কারক। নির্ণয়ের কৌশল: ক্রিয়াকে ‘কী/কোথা থেকে/হইতে/হতে’ বা ‘কাকে'(ভয়-এর ক্ষেত্রে) যোগে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যা, তা-ই হচ্ছে অপাদান কারক। যেমন: ক. গাছ থেকে আম পড়ে। কোথা থেকে আম পড়ে? গাছ থেকে— অপাদান কারক। খ. বিপদ থেকে রক্ষা করো। কী থেকে রক্ষা করো? বিপদ— অপাদান কারক। গ) ফ্যান্টমকে সবাই ভয় পায়। কাকে ভয় পায়? ফ্যান্টমকে— অপাদান কারক।
৬. অধিকরণকারক: বাক্যে ক্রিয়া সম্পাদনের কাল(সময়) এবং আধার(স্থান)-কে অধিকরণ কারক বলে। নির্ণয়ের কৌশল: ক্রিয়াকে ‘কোথায়’ বা ‘কখন’ যোগে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায়, তা-ই অধিকরণ কারক। যেমন: ক. সন্ধ্যায় ছোটো বন্ধুকে কারক নির্ণয়ের সহজ কৌশল সম্পর্কে বার্তা পাঠাতে হবে। কখন পাঠাতে হবে? সন্ধ্যায়— অধিকরণ কারক। খ. ছাফিয়া স্কুলে গিয়েছে। কোথায় গিয়েছে? স্কুলে— অধিকরণ কারক। গ. পুকুরে মাছ আছে। কোথায় মাছ আছে? পুকুরে— অধিকরণ কারক।
জ্ঞাতব্য: ১. ‘কে’ ও ‘রে’ বিভক্তি সম্প্রদান কারকের ক্ষেত্রে চতুর্থী এবং অন্যান্য কারকের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়া হিসেবে উল্লেখ করতে হবে। ২. নিমিত্তার্থেও সম্প্রদান কারকে চতুর্থী বিভক্তি হবে। যেমন: বেলা যে পড়ে এল জলকে(জলের নিমিত্তে) চল। কীসের নিমিত্তে চল? জলের— নিমিত্তার্থে চতুর্থী বিভক্তি।
উৎস: ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।
ইদওঈদ বাংলাএকাডেমিআধুনিবাংলাঅভিধানমতেইদওঈদ–এরঅর্থ ইদ: ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব (ইদুল ফিতর বা ইদুল আজহা); খুশি, উৎসব; ঈদ-এর সংগততর ও অপ্রচলিত বানান।
ইদগাহ: যে স্থানে একত্র হয়ে ইদের নামাজ পড়া হয়। ঈদগাহ-এর সংগততর ও অপ্রচলিত বানান। ইদি : ইদ উপলক্ষ্যে ছোটোদের দেয় সালামি; ঈদি-র সংগততর ও অপ্রচলিত বানান। ইদুজ্জোহা: ইদুল আজহা। ইদুল-আজহা: হিজরি পঞ্জিকার জিলহজ মাসের দশম দিনে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পালনীয় উৎসব ( যে উৎসবে পশু কোরবানি দেওয়া হয়); ঈদুল-আজহা-এর সংগততর ও অপ্রচলিত বানান। ইদুলফিতর: ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মাসব্যাপী নির্জলা উপবাসব্রত পালনের পর হিজরি পঞ্জিকার শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে উদ্যাপিত উৎসব; ঈদুলফিতর-এর সংগততর ও অপ্রচলিত বানান।
ঈদ: ইদ-এর প্রচলিত ও অসংগত বানান। ঈদি: ইদি-র প্রচলিত ও অসংগত বানান। ঈদগাহ: হদগাহ-এর প্রচলিত ও অসংগত বানান। ইদুজ্জোহা: ‘ইদুজ্জোহা’-র প্রচলিত অসংগত বানান। ঈদুলফিতর: ‘ইদুলফিতর’-্এর অসংগত ও প্রচলিত বানান।
বাংলায় ধ্বনিমূলগত বা উচ্চারণগত কোনো দীর্ঘস্বর নেই। তাই ‘ইদ’ ও ‘ঈদ’ উভয় শব্দের উচ্চারণ অভিন্ন। প্রশ্ন আসতে পারে, তা হলে বানান পরিবর্তনের কারণ কী? কারণ আছে এবং তা অনেকের মতে যথেষ্ট যৌক্তিক। শব্দের অর্থ দ্যোতনা, বানানে আদর্শমান প্রতিষ্ঠা ও সমতা রক্ষার স্বার্থে বাংলা একাডেমি, বিদেশি শব্দ হিসেবে আরবি عيد শব্দের বানান ‘ইদ’ করেছে। তবে কেউ ‘ঈদ’ লিখলে সেটির উচ্চারণও হবে ‘ইদ’। অবশ্য কেউ যদি আরবি উচ্চারণ করেন সেটি অন্য বিষয়। আবার অনেকের প্রশ্ন, তাহলে ইংরেজি হতে আগত Keyboard শব্দের বানান কেন ‘কী-বোর্ড’ করা হলো? চিন বানান কেন প্রচলন বিবেচনায় ‘চীন’ রেখে দেওয়া হলো? এমন আরও অনেক সাংঘর্ষিক বানান বাংলা একাডেমি করেছে।
‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান (২০১৬)’ ও ‘বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (২০১৫)’ অনুযায়ী عيد (Eid) শব্দের প্রমিত ও সংগততর বাংলা বানান ‘ইদ’। عيد (Eid) বিদেশি শব্দ। তাই প্রমিত বানানরীতি অনুসারে শব্দটির প্রমিত ও সংগততর বাংলা বানান ‘ইদ’, ‘ঈদ’ নয়। শব্দটির বানানে ‘ঈ’ বা ‘ই’ যা-ই দেওয়া হোক না কেন; উচ্চারণের, সম্মানের বা গাম্ভীর্যের কোনো পরিবর্তন হবে না, কিন্তু ‘ই’ দিলে প্রমিত বানানরীতি প্রতিষ্ঠা ও ভাষার আদর্শমান এবং ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। যা ভাষাকে করবে আরও সর্বজনীন, বোধগম্য, অভিন্ন ও প্রমিত। কিন্তু তা কীভাবে হবে? সামান্য ব্যাঙ বানানেও একাডেমির সাংঘর্ষিকতা দেখা যায়। তৎসম আর অতৎস নিয়েও আছে দ্বন্দ্ব।
বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান [প্রথম খণ্ড (অ-ঞ) প্রথম প্রকাশ জ্যৈষ্ঠ ১৪২০/জুন ২০১৩] মতে, ‘ঈদ’ শব্দের প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায় আলাওলের লেখায়। ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে আলাওল লিখেছেন, ‘জুম্মা দুই ঈদ আর আরফা সিনান’। ‘ইদ’ শব্দের প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায় ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে অক্ষয়কুমার দত্তের ‘কি ইদ, কি মহরম কোন মোসলমান …’ লেখায়।
২০০০ সংস্করণের বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান [পরিমার্জিত সংস্করণ ডিসেম্বর ২০০০-এর অষ্টাদশ পুনর্মুদ্রণ: মাঘ ১৪২১/জানুয়ারি ২০১৫]-এ ‘ইদ’ বানান সম্পর্কে লেখা হয়েছে, “ইদ, ইদগাহ ⇒ ঈদ”। বাংলা একাডেমি বাংলা বানান-অভিধান [পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৮-এর পঞ্চম পুনর্মুদ্রণ জানুয়ারি ২০১৫]-এ লেখা আছে, “ইদ /id ইদ্/ (ঈদ-এর সংগততর ও অপ্রচলিত বানান)।” ২০১২ সংস্করণের বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম ২.১ [পরিমার্জিত সংস্করণ ২০১২ (মুদ্রণ-২০১৫)] উল্লেখ করা হয়েছে, “সকল অতৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের কারচিহ্ন হ্রস্ব ই-কার, হ্রস্ব উ-কার ব্যবহৃত হবে।” সে হতে ‘ইদ’ বানান আরো পোক্ত এবং বিধিবদ্ধ হয়ে যায়।
ভাষা বহমান নদীর মতো নয়, চলমান প্রকৃতির মতো, নদী প্রকৃতির একটি উপাদান মাত্র। ভাষার পরিধি তার চেয়েও ব্যাপক। প্রত্যেক ভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয় পরিক্রমা রয়েছে। প্রাচীনত্বের অজুহাতে ভাষার স্বকীয়তা এবং ভাষাপ্রকৃতির সাবলীল পরিবর্তনে বাধা দিয়ে ঐকমত্য সৃষ্টিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা সমীচীন হবে বলে মনে হয় না।
অনেকে বলেন, ‘ইদ’ বানান এখনও ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়নি। সম্মানিত শুবাচি জনাব Khurshed Ahmed এর ভাষায় বলা যায়, “আপনি-আমি শুরু করলেই সংগততর ‘ইদ’ বানানটি প্রচলিত হতে শুরু করবে।” শব্দটির বাংলা বানান নিয়ে বির্তকের এক পর্যায়ে একাদশ শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী শুবাচি জনাব Minha Siddika মন্তব্য করেছেন : “আমাদের ঐকমত্য দূরহ বিষয়, যে কোনো ক্ষেত্রে। ঈদ বানান ইদ হলে ‘Kyeboard’ বানান কেন ‘কি-বোর্ড’ না-করে ‘কী-বোর্ড’ করা হলো?
মনসামঙ্গল সর্পের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসার কাহিনী নিয়ে রচিত কাব্য মনসামঙ্গল কাব্য। ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে, কমপক্ষে ৬২ জন কবি ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেছেন। নারায়ণ দেব, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাই, দ্বিজ বংশীদাস, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, ষোড়শ শতকের কবি গঙ্গাদাস সেন, সপ্তদশ সতকের রামজীবন বিদ্যাভূষণ, বাণেশ্বর, জীবন মৈত্র প্রমূখ মনসামঙ্গল কাব্য ধারার উল্লেখযোগ্য কবি।
মনসামঙ্গলধারারআদিকবি কানা হরিদত্ত ছিলেন মনসামঙ্গল কাব্যের আদিকবি। চতুর্দশ শতকের প্রথম দিকে পূর্ববঙ্গে কবি কানা হরিদত্ত জন্মগ্রহণ করেন। পঞ্চদশ শতকের শেষভাগের কবি বিজয়গুপ্ত কানা হরিদত্তকে মনসামঙ্গল কাব্যের আদিকবি বলে আখ্যায়িত করেছেন।
মনসামঙ্গলেরশ্রেষ্ঠকবি মনসামঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি নারায়ণ দেব। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার বোরগ্রামে পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কাব্যের নাম ‘পদ্মপুরাণ’। কাব্যগ্রন্থটি তিন খ-ে বিভক্ত। তাঁকে মনসামঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি বলা হয়।
সুস্পষ্টসনযুক্তমনসামঙ্গলকাব্য বাংলা সাহিত্যে সুস্পষ্ট সনযুক্ত মনসামঙ্গল কাব্যের প্রথম রচয়িতা বিজয়গুপ্ত। তিনি গৌড়েশ্বর সুলতান হুসেন শাহের আমলে ১৪৯৪ খ্রিষ্টাব্দে মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেন। বরিশাল জেলার গৈলা গ্রামে কবি বিজয়গুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন। মনসামঙ্গল কাব্যের আরেক জন কবি বিপ্রদাস পিপিলাই। তার রচিত কাব্য ‘মনসাবিজয়’ ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
বিপ্রদাসপিপিলাই বিজয়গুপ্তের সামসময়িক কবি বিপ্রদাস পিপিলাই। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল রচনার এক বছর পর ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘মনসাবিজয়’ কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেন। কথিত হয় যে, বিপ্রদাস পিপিলাই স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের আমলে ‘মনাসবিজয়’ কাব্য রচনা করেন।
দ্বিজবংশীদাস কবি চন্দ্রাবতীর পিতা দ্বিজ বংশীদাস সপ্তদশ শতকের শেষভাগে, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, তিনি ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেছিলেন। কাব্যে কবি দ্বিজ বংশী, বংশীধর, বংশীবাদন প্রভৃতি ভণিতা ব্যবহার করেছেন।
সূত্র: বাংলা সাহিত্য ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহা, ড. মোহাম্মদ আমীন, আগামী প্রকাশনী।