বাংলা ভাষার মজা: বোদা ভোঁদা ও ভোদা, হিন্দুর জল, মুসলিমের পানি, বাংলা বাঙলা বাঙালা বাঙ্গলা ও বাঙ্গালা, ফুলের শুভেচ্ছা ও ফুলেল শুভেচ্ছা

বাংলা ভাষার মজা: বোদা ভোঁদা ও ভোদা, হিন্দুর জল, মুসলিমের পানি, বাংলা বাঙলা বাঙালা বাঙ্গলা ও বাঙ্গালা, ফুলের শুভেচ্ছা ও ফুলেল শুভেচ্ছা

শাহজাদা সামস

বাংলা ভাষার মজা’ ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা একটি অসাধারণ গ্রন্থ। বাংলা ভাষা কত অনুপম সৌন্দর্য ধারণ করে তা গ্রন্থটি পড়লে অনুধাবন করা যায়। গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন খ্যাতিমান অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, প্রচ্ছদ করেছেন: ধ্রুব এষ।  প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.। মূল্য: ৫৫০ টাকা। গ্রন্থটির কয়েকটি ভুক্তি নিচে তুলে ধরা হলো।

বোদা ভোঁদা ও ভোদা

বোদা দেশি শব্দ।বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত বোদা শব্দের অর্থ স্বাদহীন, বিস্বাদ প্রভৃতি। স্থান-নাম বিশ্লেষণে অর্থ পাওয়া যায়— জ্ঞানী, বোদ্ধা, পণ্ডিত, ঈশ্বর, বোয়াল মাছ প্রভৃতি। এক্ষেত্রে ‘বোদ্ধা’ বা ‘জ্ঞানী’ শব্দ হতে ‘বোদা’ শব্দের উদ্ভব। যেমন:
বুদ্ধ ছিলেন যুগের শ্রেষ্ঠ বোদা(জ্ঞানী, পণ্ডিত)।
ঢাকার যানজট জীবনটাকে বোদা(বিস্বাদ) করে দিল।
বোদা(বোয়াল মাছ) মাছটি ধরতে অনেক কষ্ট হয়েছে।
অনেকের মতো, ‘বোদা’ শব্দটি গৌতম বুদ্ধের সংক্ষিপ্ত নাম ‘বুদ্ধ’ শব্দের আঞ্চলিক রূপ। বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলায় ‘বোদা’ নামের একটি উপজেলা রয়েছে।
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘ভোদা’ বানানের কোনো শব্দ নেই। তবে ‘ভোঁদা’ বানানের একটি শব্দ আছে। অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত দেশি ‘ভোঁদা’ শব্দের অর্থ— স্থূলকায়, মোটা, মাংসল, স্থূলবুদ্ধি, বোকা, হাবাগোবা ইত্যাদি। যেমন:
ভোঁদা (স্থুলকায়) ছেলেটির হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।
ছেলেটি এত ভোঁদা(হাবাগোবা) যে, নিজের নামটিও ভালোভাবে বলতে পারে না।

হিন্দুর জল, মুসলিমের পানি

জনাব Mûr Phy-এর প্রশ্ন: “হিন্দুরা সাধারণত ‘জল’ বলে কিন্তু মুসলিমরা ‘পানি ’ বলে কেন? জল আর পানি উভয়ের জন্ম উচ্চবংশ নামে কল্পিত সংস্কৃত।* সংস্কৃতের চোখে

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

গরিব-শূদ্র, নীচ ও অপাঙ্‌ক্তেয় হিসেবে চিহ্নিত সাধারণ মানুষের ভাষা বাংলা তার অবহেল্য প্রতিবেশী। সংস্কৃত পানীয় থেকে পানি শব্দের উদ্ভব। সংস্কৃত নামের উচ্চবংশে জন্মগ্রহণকারী ‘পানীয়’ ‘সংস্কৃত’ নামের বাপের বাড়ি হতে বাংলা নামের আত্মীয়-বাড়ি বেড়াতে এসে নীচ বাংলার প্রেমে পড়ে জাতকুল হারিয়ে খাঁটি বাংলা ‘পানি’ রূপ ধারণ করে। ফলে জাতকুল-হারা ‘পানি’ হিন্দু ও সংস্কৃত পণ্ডিতবর্গের কাছে অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে যায়। তাই তারা পানিকে ত্যাজ্য করে।

.
জল একদম খাঁটি সংস্কৃত শব্দ। সংস্কৃত জল সংস্কৃত হতে আত্মীয় বাড়ি বাংলায় বেড়াতে এলেও গরিব ও নীচ জাত হিসেবে অবহেলিত বাংলার প্রেমে পড়েনি। বরং বাংলাই তাকে একতরফা ভালোবাসা দিয়ে নিজের করে নেয়। যদিও সে প্রকৃতপক্ষে নিজের মূলোৎস হতে বিন্দুবৎ বিচ্যুত হয়নি। মূল অবয়ব আর জাতকুল পুরো অক্ষুণ্ণ রেখেছে। তাই হিন্দু আর পণ্ডিতবর্গের কাছে জল, পানির মতো অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে যায়নি। আগের মতোই আদরণীয় রয়ে গেছে। বর্ণিত কারণে, হিন্দুরা জাতকুল-হারা পানিকে বেশি আপন করে নিতে পারেনি।হিন্দুদের কাছে মুসলিমরা ছিল জাতকুল-হারা পানির মতো অপাঙ্‌ক্তেয় । জাতে জাত টানে। হিন্দুদের কাছে অপাঙ্‌ক্তেয় মুসলিমরা কী আর করবে! বিকল্প নেই; হয় জল নয় পানি। শত্রুর শত্রু বন্ধুই তো হয়, নাকি! তাই অপাঙ্‌ক্তেয় হিসেবে অপাঙ্‌ক্তেয় পানিকে তারা আপন করে টেনে নেয় বুকে। তবে, জল বলুন, আর পানি বলুন; জিনিসটা কিন্তু এক।

বাংলা বাঙলা বাঙালা বাঙ্গলা ও বাঙ্গালা

বৈয়াকরণদের বিশ্লেষণে জানা যায়, ‘বঙ্গ’ শব্দ থেকে বাঙ্গালা ও বাঙালি শব্দের উদ্ভব। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণেও অভিন্ন বিষয় ওঠ আসে। অনেক বছর আগে, মূলত ভাষা ও জাতি অর্থে ‘বাঙ্গালা’ এবং ‘বাঙ্গালি’ শব্দের প্রচলন শুরু হয়। কালক্রমে তা হয়ে দাঁড়ায় বাঙলা, বাঙালি এবং আরও পরে বাংলা শব্দে এসে স্থিতি লাভ করে। আ-কার থাকায় জাতি অর্থ

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

প্রকাশে অনুস্বার বাদ দিয়ে ‘বাংলা’ শব্দটিকে ‘বাঙালি’ লেখা হয়। কারণ, অনুস্বারে স্বরচিহ্ন যুক্ত করার নিয়ম নেই। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অনুস্বার (ং) অনুমোদন করেননি। তিনি নিজে বিভিন্ন সময়ে বাঙ্গালা, বাঙ্গলা ও বাঙ্লা লিখেছেন। কখনো ‘বাংলা’ লেখেননি। তিনি বলেছেন, “সঙ্গতি রাখিবার জন্য অনুস্বার দিয়া বাংলা না লিখিয়া চলতি ভাষায় বাঙলা (বাঙ্‌লা) লেখাই ভাল।” বঙ্গ শব্দের উদ্ভব ঘটেছে বঙ্গা থেকে। বঙ্গা অর্থ সূর্য। আর্য তো দূরের কথা দ্রাবিঢ়দেরও পূর্বে এদেশের মানুষ বঙ্গাকে দেবতা হিসেবে মান্য করত। তখন কোনো ধর্ম বা ধর্মীয় বিধি-বিধানের সৃষ্টিও হয়নি।

.
সূর্যকে অনেক দেশে দেবতা হিসেবে গ্রহণ করলেও তাদের বহু পূর্বে এদেশের মানুষ বিশ্বের মধ্যে প্রথম বঙ্গা অর্থাৎ সূর্যকে দেবতারূপে স্বীকার করেছে। এজন্য গবেষকেদের ধারণা বঙ্গা থেকে দেশের নাম হিসেবে বঙ্গ শব্দের উদ্ভব। এতদ্‌ঞ্চলের আদি ভাষা ছিল প্রাকৃত। তাকে সংস্কার করে হয়েছে সংস্কৃত। সুতরাং সংস্কৃত আলাদা কোনো ভাষা নয়। বাংলা ভাষারই একটি পণ্ডিতি রূপ মাত্র। প্রাকৃত তথা বাংলা থেকে সৃষ্ট সংস্কৃত ভাষাটি পণ্ডিতদের দখলে থাকায় সাধারণ মানুষ তাকে প্রত্যাখান করেছে। সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত শব্দের বাহুল্য বর্জন করে দেশি-বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটানোর রেওয়াজ শুরু করেন। ভাষা যেহেতু গণমানুষের তাই তাদের প্রয়োগরীতিকে অস্বীকার করা যায় না। তাই ভাষায় পরিবর্ত অনিবার্য। বাংলা সেই অনিবার্যতার একটি মনোরম ও সর্বজনীন রূপ।

ফুলের শুভেচ্ছা ও ফুলেল শুভেচ্ছা

সংস্কৃত ‘ফুল্ল’ শব্দ থেকে উদ্ভূত এবং বিশেষণ পদ হিসেবে ব্যবহৃত তদ্ভব ‘ফুল’ শব্দের অর্থ- পুষ্প বা কুসুম প্রভৃতি। ফুলের অর্থ- পুষ্পের, পুষ্পের তৈরি প্রভৃতি। যেমন : ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না। ফুলের মতো সুন্দর। ফুলের মালা। বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হিন্দি ‘ফুলেল’ শব্দের অর্থ- পুষ্পময়, কুসুমিত, ফুলের মতো মোহনীয়, ফুলের গন্ধযুক্ত প্রভৃতি। যেমন : শিক্ষার্থীরা প্রধান অতিথিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাল। “ফুলের শুভেচ্ছায় প্রধান অতিথি আপ্লুত হলেন”- বাক্যটি হবে হাস্যকর। কারণ, ফুল কাউকে নিজ থেকে শুভেচ্ছা দিতে পারে না।তাই, “ফুলেল শুভেচ্ছায় প্রধান অতিথি আপ্লুত হলেন”- লেখাই যৌক্তিক হবে। “জাফরের শুভেচ্ছায় প্রধান অতিথি আপ্লুত হলেন” বাক্যের অর্থ : জাফর নামের ব্যক্তির দেওয়া শুভেচ্ছায় প্রধান অতিথি আপ্লুত হলেন, কিন্তু “ফুলের শুভেচ্ছায় প্রধান অতিথি আপ্লুত হলেন”- বাক্যের অর্থ হবে, ‘ফুল কর্তৃক প্রদত্ত শুভেচ্ছায় প্রধান অতিথি আপ্লুত হলেন’।
————————————————————————–