কাচ পচা যাবৎ তফাত দাঁড়ি দাড়ি গাঁ গা সাধারণ ও পর্যবেক্ষণ: নিমোনিক প্রমিত বাংলা বানান

ড. মোহাম্মদ আমীন

  • কাচ: কাচ বানানে চন্দ্রবিন্দু নেই। কাচের জিনিস ভেঙে গেলে চন্দ্রও ভেঙে যেতে পারে। তাই কাচ বানানে চন্দ্রবিন্দু দেবেন না। একটা মাত্র চাঁদ, ভেঙে গেলে জ্যোৎস্না আপুর কী হবে?
  • পচাপচা বানানে চন্দ্রবিন্দু নেই। যেমন: পচা মাছ। পচা জায়গায় চন্দ্র থাকে না। পচা মাথায় চন্দ্রবিন্দু দেবেন না। পাঁচ-এর মাথায় দেবেন।
  • পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি

    যাবৎ: যাবৎ বানানে ত নেই, ৎ দিতে হবে। যাবৎ বানানে আস্ত-ত দিলে ‘যাব ত’ হয়ে যাবে। যাবৎ আর ‘যাব ত’ এক জিনিস নয়।

  • এযাবৎ: এযাবৎ লিখুন, এযাবত লিখবেন না।
  • তফাত: তফাত বানানে ৎ নেই, দুটোই আস্ত-ত। কাউকে আস্ত-ত আবার কাউকে খণ্ড-ৎ দিলে পাপ হবে। ন্যয়বিচার করুন। আল্লাহ দয়া করবেন।
  • উচিত: উচিত বানানে ৎ দেবেন না। প্রিয়জনের জন্য খণ্ড জিনিস নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। উচিত মানুষ কখনো অনুচিত কাজ করে না।
  • দাড়ি, দাঁড়ি: মুখের দাড়িতে চন্দ্রবিন্দু নেই, কিন্তু বাক্যের দাঁড়িতে চন্দ্রবিন্দু লাগবে। মুখের দাড়ি ঝুলে থাকে। তাই চন্দ্রবিন্দু পড়ে যায়। বাক্যের দাঁড়ি, দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথায় দাঁড়া বানানের চন্দ্রবিন্দু দিলে পড়ে না।
  • গা গাঁ: গা যদি শরীর হয় চন্দ্রবিন্দু দেবেন না। গাঁ যদি গ্রাম হয়, চন্দ্রবিন্দু দিতে হয়। শরীরের ওপর চন্দ্রবিন্দু থাকে না; গ্রামের ওপর চন্দ্রবিন্দু থাকে।
    কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো রূপকথা নয় সে নয়—। হেমন্ত বাবুর গানটি মনে রাখবেন।
  • সাধারণ: ‘সাধারন’ নয়, ‘সাধারণ’। তৎসম শব্দে র-এর পরের ন, ণ হয়ে যায়।
  • পর্যবেক্ষণ: ‘পর্যবেক্ষন’ নয় লিখুন ‘পর্যবেক্ষণ’। তৎসম শব্দে ষ বা ক্ষ (ক্‌+ষ)-এর পরের ন, ণ হয়ে যায়।
উৎস: নিমোনিক প্রমিত বাংলা বানান অভিধান, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

Leave a Comment

প্রয়োগ বনাম ব্যবহার: প্রয়োগ এবং ব্যবহার শব্দের পার্থক্য

. মোহাম্মদ আমীন

প্রয়োগ বনাম ব্যবহার: প্রয়োগ এবং ব্যবহার শব্দের পার্থক্য

বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘প্রয়োগ’ শব্দের অর্থ প্রযুক্তির ব্যবহার, ব্যবহারের ধরণ, নিয়োগ, দৃষ্টান্ত, ব্যবহার, উল্লেখ প্রভৃতি। ‘প্রয়োগ’ শব্দের ছয়টি অর্থ দেওয়া হলেও সাধারণত ‘প্রয়োগ’ শব্দটি প্রযুক্তির ব্যবহার, ব্যবহারের ধরণ, দৃষ্টান্ত, উল্লেখ এবং কার্যকারতা প্রভৃতি অর্থে অধিক ব্যবহৃত হয়। আমি মনে করি, ‘প্রয়োগ’ শব্দটি প্রযুক্তি, ব্যবহারের ধরণ, বাক্যবিশেষে ব্যবহার প্রভৃতি অর্থে স্থাপন করা অধিক সমীচীন। অর্থ প্রকাশে বিঘ্ন ঘটার শঙ্কা থাকার কারণ ঘটে বলে ইংরেজি use অর্থ প্রকাশে  ‘প্রয়োগ’ শব্দটি যত কম ব্যবহার করা যায় তত ভালো। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘প্রয়োগ’ এবং ‘ব্যবহার’ অভিন্নার্থে ব্যবহার করলেও বাক্যের গুণগত মান বা অর্থের তারতম্য হবে না। যেমন : “বল শব্দের তিনটি ভিন্নার্থক প্রয়োগ দেখান।” এই বাক্যে আপনি ‘প্রয়োগ’ শব্দের স্থলে ‘ব্যবহার’ লিখতে পারেন।এবার শব্দটির পদার্থ দেখা যাক :

  • ১. বানরের উপর এই ওষুধটি প্রয়োগ করে দেখতে পারেন।
  • ২. তোমার ব্যবহার ভালো ছিল, কিন্তু প্রয়োগটা শোভনীয় ছিল না।
  • ৩. প্রয়োগটি (দৃষ্টান্ত) যথার্থ ছিল।

বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘ব্যবহার’ শব্দের অর্থ – আচরণ (মার্জিত ব্যবহার), স্বভাব, মামলা-মোকাদ্দমা, আইন(ব্যবহারজীবী), কাজে প্রয়োগ (ব্যবহার করা), বিষয়কর্ম, বাণিজ্য। ‘ব্যবহার’ ‘শব্দের’ এতগুলো অর্থ থাকলেও বাক্যে এসব অর্থ পেতে হলে আপনাকে বাক্য বুঝে তা বসাতে হবে। ‘ব্যবহার’ শব্দটি সাধারণত আচরণ, আইনজীবী, কাজে প্রয়োগ, সাধারণ স্বভাব প্রভৃতি অর্থ প্রকাশে অধিক ব্যবহৃত হয়। যেমন :

  • ৪. তার ব্যবহার (আচরণ) ভালো ছিল না।
  • ৫. ব্যবহারজীবী (আইনজীবী) হিসেবে তিনি ব্যবহারে (মামলা-মোকাদ্দমা) বেশ দক্ষ।
  • ৬. যন্ত্রটির ব্যবহার (প্রয়োগ) তুমি জানো কি?
  • ৭. এটিই তার জন্মগত ব্যবহার (স্বাভাবিক আচরণ)।

‘প্রয়োগ’ শব্দের একটি অর্থ ‘ব্যবহার’ হিসেবে উল্লেখ থাকায় অনেকে বলেন, ‘প্রয়োগ’ ও ‘ব্যবহার’ শব্দকে সমার্থক মনে করা যায়। কিন্তু এই সমার্থকতা সব বাক্যে সর্বস্থানে বসানোর চেষ্টা করলে বাক্যের অর্থে ভীষণ অনর্থ ঘটতে পারে। যেমন : “তুমি আমার গাড়িটা কিছুদিন ব্যবহার করতে পারো।” বাক্যটি যদি আপনি এভাবে লিখেন, “ তুমি আমার গাড়িটা কিছুদিন প্রয়োগ করতে পারো”, তাহলে বিষয়টা হাস্যকর হয়ে যাবে। যেখানে ‘ব্যবহার’ শব্দটি কারো আচরণকে প্রকাশের জন্য প্রয়োগ করা উচিত , সেখানে ‘প্রয়োগ’ শব্দ দিয়ে তা করতে গেলে আপনি অজ্ঞতার পরিচয় দেবেন। যেমন: “বয়স্ক লোকটার সঙ্গে তোমার এমন ব্যবহার করা উচিত হয়নি।” বাক্যটি যদি আপনি লিখেন “বয়স্ক লোকটার সঙ্গে তোমার এমন প্রয়োগ করা উচিত হয়নি”। কেমন হবে? ‘ব্যবহার’ শব্দের আর একটি প্রয়োগ আইনজীবী নির্দেশে। আইনজীবীর অপর নাম ব্যবহারজীবী, ‘ব্যবহার’ এবং ‘প্রয়োগ’ সমার্থক ধরে নিয়ে যদি লিখেন, আমার বাবা একজন প্রয়োগজীবী, তাহলে অনর্থ অনিবার্য।

অতএব, ‘প্রয়োগ’ এবং ‘ব্যবহার’ শব্দের প্রয়োগ ও ব্যবহারে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়। আচরণ, স্বভাব, আইনজীবী, প্রকাশে ব্যবহার শব্দটি নিশ্চিত ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু কার্যকারত, প্রযুক্তি কিংবা ব্যবহারের ধরণ প্রভৃতি। প্রকাশে ‘প্রয়োগ’ শব্দের ব্যবহার অধিকতর নিরাপদ। যে যাই বলুন,  ‘প্রয়োগ’ ও ‘ব্যবহার’ বড়ো হতভাগা।  আমরা প্রত্যহ কতভাবে শব্দদুটো ব্যবহার করছি,  কত কৌশল-অকৌশলে প্রয়োগ করে যাচ্ছি; তবু বেচারদ্বয়র উপস্থিতি কবিতায় আর গানে নেই বললেই চলে। কাজের লোকের মতো কাজের শব্দও ভালো আসনে বসতে পারে না, সবাই অপাঙ্‌ক্তেয় রেখে দেয়।

“রাগ করো না ‘প্রয়োগ’ তুমি, রাগ করো না ‘ব্যবহার’

অপাঙ্‌ক্তেয় নও তোমরা পঙ্‌ক্তি-ভরা রূপ বাহার।” 

উৎস: কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

Leave a Comment

অপরাধ দোষ ত্রুটি ও ভুল: পার্থক্য বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগ

ড. মোহাম্মদ আমীন

অপরাধ দোষ ত্রুটি ও ভুল: পার্থক্য বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগ

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন, “বসে আছি পথ চেয়ে ফাগুনের গান গেয়ে/ যত ভাবি ভুলে যাব মন মানে না- –।” এই পঙ্‌ক্তিদ্বয়ে ‘ভুল’ শব্দের স্থলে কি অন্য শব্দ চলে? চলে না। নজরুল লিখেছেন, “ কেউ ভোলে না কেউ ভোলে, অতীত দিনের স্মৃতি—”। এই দুই ক্ষেত্রেই  নজরুল আর হেমন্ত- উভয়ের ‘ভুল’ অভিন্ন অর্থ বহন করে। কিন্তু , “ভুল করে যদি ভালোবেসে থাকি, ক্ষমিও সে অপরাধ।” নজরলের এই ভুলের অর্থ আগের দুই ভুলের মতো বিস্মৃতি নয়, দোষ, ভ্রান্তি প্রভৃতি। 

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অপরাধ, দোষ, ত্রুটি ও ভুল পরস্পর সমার্থক মনে হলেও, তা কদাচিৎ; প্রকৃতপক্ষে তারা, বিশেষ করে ‘অপরাধ’ ও বাকি তিনটি শব্দ  বিরল ক্ষেত্রে সমার্থক।  প্রত্যেকটির রয়েছে স্বকীয়তা, নিজস্ব অর্থ দ্যোতনা। দোষ ও ত্রুটি কখনও ভুল হতে পারে, না-ও হতে পারে; অপরাধের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। সৈয়দ আবদুল হাদী গেয়েছেন, “আমার দোষে দোষী আমি নিজের বিচার চাই, আমার ভুলের কোনো ক্ষমা নাই।”  এখানে ‘দোষে’ পদের অর্থ অপরাধে, ‘দোষী’ পদের অর্থ অপরাধী এবং ‘ভুলে’ পদের অর্থ বিস্মৃতি।

সংস্কৃত ‘অপরাধ’ শব্দের অর্থ গর্হিত কাজ, দোষ, ত্রুটি, পাপ, অধর্ম প্রভৃতি। বাক্যে শব্দটি সাধারণভাবে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অপরাধের সঙ্গে আইনগত বিষয় অধিক জড়িত। সাধারণত গর্হিত কাজ, পাপ, অধর্ম প্রভৃতি অর্থ প্রকাশে ‘অপরাধ’ শব্দটি অধিক ব্যবহৃত হয়।  যেমন : “চৌর্যবৃত্তি একটি অপরাধ”। শব্দার্থ বিবেচনায় ‘অপরাধ’ শব্দটির একটি অর্থ ‘দোষ/ত্রুটি’ দেখা গেলেও পদার্থ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘দোষ’ ও ‘ত্রুটি’ প্রকাশে বাক্যে অপরাধ শব্দটি তেমন ব্যবহার হয় না। তবে মাঝে মাঝে অপরাধ শব্দটি ‘দোষ’ প্রকাশেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। নজরুল, কিন্তু সুন্দর প্রিয়তমার দিকে তাকানোকেও অপরাধ গণ্য হতে দেখেছেন : “তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সে কি মার অপরাধ/ চাঁদেরে হেরিয়া কাঁদে চকোরিনী বলে না তো কিছু চাঁদ”। নজরুলের এই গানে সাধারণভাবে ‘অপরাধ’ শব্দের অর্থে দোষ শব্দটিও ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এখন মেয়েদের দিকে, বিশেষ করে সুন্দর মেয়েদের দিকে তাকানো দোষ নয়, তার চেয়ে মারাত্মক এবং সেটি হচ্ছে অপরাধ। এজন্য আপনি নারী উত্যক্ত করার অপরাধে দোষী হতে পারেন, মামলা হয়ে যেতে পারে ‘নারী নির্যাতন’ আইনে। 

সংস্কৃত ‘দোষ’ (বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত) শব্দের অর্থ অন্যায়, অপরাধ, অনৈতিক কাজ (দোষ করা), ত্রুটি, খুঁত (দোষ করা), কু-অভ্যাস (পানদোষ), ফের, কুপ্রভাব (গ্রহের দোষ), ক্ষতি, দ্বেষ, নিন্দা, পাপ, আয়ু (বায়ু পিত্ত কফ) ত্রিদোষ প্রভৃতি। যেমন : কী দোষ ছিল যে আমার, করছ আমায় তুমি পর–।দোষ যে করে সে দোষী। যেমন : দোষী করতে জানে বন্ধু খুশি করতে জানে না – – –। সংস্কৃত ‘ভ্রম’ থেকে উদ্ভূত ‘ভুল’ শব্দের অর্থ বিশেষ্যে ভ্রম, ভ্রান্তি, প্রমাদ (ভুলে ভরা), বিস্মৃতি (ভুলে যাওয়া), প্রলাপ (ভুল বকা); বিশেষণে শব্দটির অর্থ ভ্রান্ত, অসত্য (ভুল ধারণা) যথার্থ নয় এমন (ভুল ব্যাখ্যা)।  যেমন : “ওগো আবার নতুন করে ভুলে যাওয়া নাম ধরে ডেকো না/হারানো স্বপন চোখে এঁকো না।” সংস্কৃত ‘ত্রুটি’ শব্দের অর্থ অপরাধ, দোষ (ত্রুটি মার্জনা, অভাব, ঘাটতি (চেষ্টার ত্রুটি নেই), ভ্রম, প্রমাদ (ত্রুটিবিচ্যুতি), ক্ষতি, হানি প্রভৃতি।এটিও বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন : আমার ত্রুটি ক্ষমা করুন।

শব্দার্থসমূহ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ‘দোষ’ শব্দের একটি অর্থ ত্রুটি/ ভুল ।  এ ছাড়া উভয় শব্দের অর্থে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এজন্য শব্দটি বিশেষ ক্ষেত্রে সমার্থক হলেও খুব কম ক্ষেত্রে সমপ্রায়োগিক। এই শব্দের প্রয়োগে আইনগত অপরাধ অধিক ব্যবহার করা অনুচিত। সাধারণত কোনো অন্যায়, অপরাধ,

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অনৈতিক কাজ, খারাপ অভ্যাস, পাপ প্রভৃতির ক্ষেত্রে দোষ শব্দটি অধিক ব্যবহৃত হয়। পদার্থে বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে : ১. তোমার এ দোষ (অপরাধ) ক্ষমা করা যায় না। ২. স্বজনপ্রীতি একটি বড়ো দোষ (অনৈতিক কাজ)। ৩. অতিরিক্ত মদ্যপান মারাত্মক দোষ (পানদোষ)। ৪. ত্রিদোষ (বায়ু পিত্ত কফ ) আয়ু কমিয়ে দেয়। ৫. গ্রহদোষ (কুপ্রভাব) সহজে ফেরানো যায় না। ৬. নরহত্যা মহা দোষ (পাপ)। ৭. কপালের ফের (দোষ), নইলে কী আর এমন হয়! ৮. নরহত্যা মহা দোষ (পাপ)। ৯. কোনো ভালো মানুষ পরের দোষ (নিন্দা) গায় না। ১০. ফণী এলো, ছাগলটা নিয়ে গেল আমার বড়ো দোষ (ক্ষতি) হয়ে গেল।

এসব বাক্যে ‘দোষ’ শব্দের স্থলে ‘ত্রুটি’ ব্যবহার করা হলে তা শোভন বা যথার্থ  হবে না; অধিকন্তু, বাক্যের অর্থও ভালোভাবে রক্ষিত হবে না। স্বজনপ্রীতি  একটি ‘দোষ’, ত্রুটি নয়। প্রতিদিন অফিসে দেরি করে আসা ‘ত্রুটি’ নয়, দোষ। কিছু কিছু দোষকে কখনও ত্রুটি বলা যায় না। যেমন : মুদ্রদোষ, বায়ুদোষ, স্বপ্নদোষ, স্বভাবদোষ,পানদোষ, চরিত্রদোষ প্রভৃতি। ‘ত্রুটি’ শব্দের একটি অর্থ অপরাধ হলেও সাধারণত ‘অপরাধ’ অর্থে ত্রুটি শব্দের ব্যবহার বিরল। সাধারণত মার্জনা, অভাব, ঘাটতি, ভ্রম, প্রমাদ, ক্ষতি, হানি প্রভৃতি অর্থে ত্রুটি শব্দটির অধিক ব্যবহার লক্ষণীয়। পদার্থে বিষয়টি দেখুন : ১১. শারীরিক ত্রুটি থাকলে সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়া যায় না। ১২. ত্রুটি (ভ্রম) হয়ে গেল, বানানটা দেখে নেওয়া উচিত ছিল। ১৩. শুদ্ধতা রক্ষায় চেষ্টার ত্রুটি (অভাব) ছিল না। ১৪. সর্বোচ্চ সতর্কতা সত্ত্বেও কিছু ত্রুটি (প্রমাদ, ত্রুটিবিচ্যুতি) রয়ে গেল। ১৫. অঙ্গত্রুটি( হানি) অপরাধ নয়।

এসব ক্ষেত্রে সাধারণত দোষ শব্দের চেয়ে ত্রুটি শব্দের ব্যবহার যৌক্তিক। আর একটি বাক্য দেখুন। ১৬. আমার ত্রুটি/দোষ মার্জনা করুন। এই বাক্যে ‘ত্রুটি’ ও ‘দোষ’ উভয় শব্দের ব্যবহার প্রথমদৃষ্টে যৌক্তিক মনে হলেও এই যোক্তিকতা নির্ভর করবে কাজের বা ঘটনার প্রকৃতির উপর। আইনগত অপরাধ সাধারণত ত্রুটি

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

হিসেবে গণ্য করা হয় না। আবার ঘাটতি বা অভাবজনিত ত্রুটিকে অপরাধ বলা সমীচীন নয়। ‘জন্মদোষ’ ও ‘জন্মত্রুটি’ বানানে অভিন্ন হলেও অর্থে ভিন্ন। প্রথমটি অপরাধজনক এবং দ্বিতীয় ঘাটতি বা খুঁতজনক।  ‘‘দোষ-ত্রুটি’ দেখিয়ে দেওয়া ভালো মানুষের কাজ নয় ” বাক্যে ‘ত্রুটিদোষ’ লিখলে কেমন হয়? ভালো হয় না। দোষ, ত্রুটির চেয়ে মারাত্মক। তাই সে জোর করে আগে থাকতে চায়। এজন্য দোষত্রুটি হয়, ত্রুটিদোষ হয় না।

অনেকে মনে করেন, ‘অপরাধ’ ‘দোষ’,‘ভুল ও ‘ত্রুটি সমার্থক। আসলে তা ঠিক নয়। যেমন : দোষ করতে জানে বন্ধু খুশি করতে জানে না।” এই বাক্যে দোষ শব্দের স্থলে ‘ত্রুটি’ চলবে না, অবশ্য ভুল চলবে। তারপরও তা যথার্থ হবে না। খুব সামান্য কিছু ক্ষেত্রে ‘ভুল’ ও ত্রুটি’ শব্দের অভিন্নার্থক প্রয়োগ করা যায়। যেমন :  মাতৃভাষায় বাক্যচয়নে এমন ভুল (ত্রুটি) ক্ষমার্হ নয়। অন্য সব ক্ষেত্রে শব্দদুটি প্রায় ভিন্নার্থক। যেমন : ১৭. ভুল হয়ে গেছে (ভ্রান্তি/ত্রুটি) ১৮. প্রশ্নপত্রে ভুলে ভরা (প্রমাদ) ১৯. কথাটি ভুলে (বিস্মৃতি) যেও না। ২০. মুমূর্ষু লোকটি ভুল (প্রলাপ) বকছে। ২১. এটি তোমার ভুল (অসত্য/ যথার্থ নয় এমন) ব্যখ্যা।

 ‘ভুল’ ও ‘ত্রুটি’ শব্দের মিলনে ‘ভুলত্রুটি’ শব্দ গঠিত হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘ভুল’ ও ‘ত্রুটি’ সমার্থক নয়। যেমন : আমি তার নাম ভুলে গেছি, সার্থক বাক্য হলেও আমি তার নাম ‘ত্রুটে’ গেছি অর্থহীন। একই কাণ্ড ঘটবে নিচের পঙ্‌ক্তি দুটোয় ‘ভুলে’ পদের স্থলে দোষ বা ত্রুটি বা অপরাধ বসালে : “তোমাকে ভুলে যাওয়া হলো না আমার এই অপরাধ ক্ষমা করো/যত ভাবি ভুলে যাব, মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায় বেশি আরো।” তারপরও একটি কথা থেকে যায়, ভুল; যতই করি না কেন, অপরাধ, দোষ, ত্রুটি বা ভুল কিছুই আমরা এড়াতে পারি না।

ভুল সবই ভুল এ জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সেই ভুল

ভুল সবই ভুল এই শ্রাবণে মোর ফাগুন যদি দেয় দেখা সে ভুল।” 

#subach

উৎস

  • কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।
  •  ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।
  • পৌরাণিক শব্দের উৎস ও ক্রমবিবর্তন, ড. মোহাম্মদ আমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

Leave a Comment

পানি ও জল: পানি বনাম জল; জলপানি, পানীয় জল, জল বনাম পানি

. মোহাম্মদ আমীন

পানি ও জল: পানি বনাম জল; জলপানি, পানীয় জল, জল বনাম পানি

পানি আগে না কি জল? মৌখিক বা লিখিত ভাষায় সাধারণত বাঙালি হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টানরা বলেন- ‘জল’, মুসলিমরা বলেন ‘পানি’। বলা হয় – ‘পানি’, বাঙালি মুসলিম এবং ‘জল’, বাঙালি হিন্দু বা বাঙালি অমুসলিম। জল-পানি ছাড়াও বাংলায় এরকম আরও কিছু শব্দ রয়েছে। বাঙালি হিন্দুরা, ‘আব্বা- আম্মা’ বলেন না, বলেন–‘ বাবা-মা’, পিসি-দাদা বলেন না, মুসলিমরা, ভাইয়া বলেন না হিন্দুরা। কথা বা লেখায় ধর্মানুসারীভেদে শব্দ ব্যবহারের এই পার্থক্যের অনেকগুলো কারণের অন্যতম হচ্ছে- সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর ধর্মীয় প্রভাব, ভুল ব্যাখ্যা, জনরব, ভ্রান্তি প্রভৃতি। তবে, ধর্মাবলম্বী ছাড়াও স্থান, পরিবেশ, পেশা, নারীপুরুষ, সম্পর্ক, অভ্যাস, আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, উঁচু-নীচু, রাজনীতি প্রভৃতিভেদেও বিশেষ বিশেষ শব্দ, বলায় কিংবা চয়নে পার্থক্য দেখা যায়। যেমন : একটি রাজনীতিক দল বলেন- ‘জিন্দাবাদ’, আর একদল বলেন, ‘দীর্ঘজীবী হোক’। আমার এক বন্ধু বলেছিলেন, যারা আাওয়ামী লীগ করেন, তারা ‘খোদা হাফেজ’ এবং যারা বিএনপি করেন তারা, ‘আল্লাহ হাফেজ’ বেশি বলেন।

‘জল’ ও ‘পানি’ দুটোই সংস্কৃতজাত শব্দ– প্রথমটি তৎসম এবং দ্বিতীয়টি তদ্ভব। সংস্কৃত ‘জল (=√জল্‌+অ)’ শব্দের বহুল প্রচলিত অর্থ পানি, বারি, সলিল প্রভৃতি।

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অন্যদিকে, সংস্কৃত ‘পানীয়’ শব্দ থেকে উদ্ভূত তদ্ভব ‘পানি’ শব্দের অর্থ জল, বারি, সলিল প্রভৃতি। বাংলায় ব্যবহৃত ‘পানি’ শব্দটি সংস্কৃত ‘পানীয়’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ। এবার পরিবর্তনটি কীভাবে হয়েছে দেখা যাক : (সংস্কৃত) পানীয়> (পালি) পানীয়> (প্রাকৃত) পাণিঅ> (বাংলা) পাণি/পাণী> পানি। প্রাকৃত শব্দ “পাণিঅ” থেকে হিন্দি, উর্দু, মারাঠি, গুজরাটি, মৈথিলী ও ওড়িয়া ভাষাও ‘বারি’ অর্থ প্রকাশে পানি শব্দটির ব্যবহার প্রচলিত হয়েছে। এবার পর্যালোচনা করে দেখি, বাংলা সাহিত্যে প্রথমে ‘পানি’ না কি ‘জল’ শব্দটির ব্যবহার চালু হয়েছিল। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলা সাহিত্যে ‘পানি’ শব্দের ব্যবহার সুপ্রাচীন, কিন্তু ‘জল’ শব্দের প্রচলন হয়েছে পরে । বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে ‘পানি’ শব্দটির প্রয়োগ পাওয়া যায়, কিন্তু ‘জল’ শব্দের প্রয়োগ পাওয়া যায় না। চর্যাপদে ভুসুক পা লিখেছেন : 
“তিণ ন চছুপইী হরিণা পিবই ন পাণী । 
হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণী ।।” 
অর্থাৎ ‘ধৃত হরিণ প্রাণভয়ের হতভম্বতায় ঘাসও খায় না, ‘পাণী (পানি)’ পানও করে না।” অতএব, বলা যায় – বাংলা সাহিত্যে ‘পানি’ শব্দটি ‘জল’ শব্দের আগে এসেছে।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর অভিমত, চর্যার পদগুলো খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে রচিত হয়েছে।ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে চর্যাপদ লিখিত হয়। আধুনিক গবেষণায় দেখা যায়, চর্যা এরও আগে রচিত হয়েছে। সে হিসেবে এখন থেকে কমপক্ষে দেড় হাজার বছর বা তারও পূর্বে বাংলায় ‘পানি’ শব্দের প্রচলন শুরু হয়েছিল; তখন জল শব্দের ব্যবহার বাংলা সাহিত্যে ছিল না।সংগতকারণে, বাঙালির মুখেও ‘জল’ ছিল না, ‘পানি’ ছিল। এর থেকে প্রমাণিত হয়ে যে, ‘পানি’ ‘জল’-এর আগে; যদিও ‘প’ বর্ণটি বর্গীয়-জ বর্ণের পরে।

চর্যা-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের আর একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। এখানেও ‘জল’ শব্দটি পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় পানি। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আছে : 
“কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।
আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ বান্ধন।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা।
দাসী হুআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি চিত্তের হরিষে।
তার পাএ বড়ায়ি মোঁ কৈলোঁ কোন দোষে।
আঝর ঝরএ মোর নয়নের পাণী।
বাঁশীর শবদেঁ বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী।”

চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বিশ্লেষণ করে বলা যায়, সেকালে বাংলা সাহিত্যে ‘জল’-এর বড়ো অভাব ছিল, কিন্তু ‘পানি’র অভাব ছিল না। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচনার যুগেও মুসলিম-অমুসলিম সব বাঙালি একসঙ্গে কেবল ‘পানি’ই পান করে গেছেন, জলের দেখা দীর্ঘ কাল পাননি। অতএব, প্রাচীন বাংলায়, তদ্ভব ‘পানি’ শব্দের ব্যবহার ছিল, কিন্তু তৎসম ‘জল’ এর ব্যবহার ছিল কি না তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। অনেক হিন্দু এবং একই সঙ্গে বহু মুসলিম মনে করেন, ‘পানি’ আরবি বা ফার্সি-জাত শব্দ। আবার অনেকে বলেন, এটি উর্দু। গবেষণায় দেখা যায়, ব্যাবহারিক প্রাচীনত্বের কারণে ‘পানি’ শব্দটি অপেক্ষাকৃত গরিব এবং অশিক্ষিত বাঙালি মুসলিম শ্রমজীবীগণ অধিক হারে ব্যবহার করায় এবং তার বিপরীতে আর একটি সহজবোধ্য সংস্কৃত শব্দ (জল) থাকায় সংস্কৃত পণ্ডিতবর্গ ‘পানি’ শব্দটিকে ইসলামি শব্দ এবং অস্পৃশ্যদের ব্যবহার্য শব্দ হিসেবে প্রচার করতে শুরু করেন। এভাবে বাংলা সাহিত্যে মুসলিম-অমুসলিম উভয়ের কাছে প্রাচীন কাল হতে ব্যবহৃত হয়ে আসা ‘পানি’ শব্দটি সংস্কৃত হতে আগত হয়েও হিন্দুত্ব হারিয়ে ফেলে। এজন্য হিন্দুরা ‘পানি’ শব্দের পরিবর্তে ‘জল’ ব্যবহার করতে শুরু করেন। ফলে ‘জল’ হয়ে যায় হিন্দুয়ানি শব্দ। প্রকৃতপক্ষে, ‘পানি’ শব্দের সঙ্গে আরবি বা ফারসি ভাষার কোনো সম্পর্ক নেই। আরবি ভাষায় ‘পানি’ অর্থ ‘মাউন’। অন্যদিকে, ফারসি ভাষায় পানিকে বলা হয় ‘আব’। সুতরাং ‘পানি’ শব্দকে ইসলামি শব্দ বলে বাঙালি হিন্দুদের তা ব্যবহার না-করার কথাটি সত্য হলেও ‘পানি’ আরবি বা ফার্সি শব্দ- এটি ঠিক নয়। যদিও উভয় পক্ষের অনেকে এমন দাবি করে থাকেন। অধিকন্তু, হিন্দুরা ছাড়াও অধিকাংশ বাঙালি অমুসলিম সাধারণত ‘পানি’ শব্দের পরিবর্তে ‘জল’ ব্যবহার করে থাকেন।

বাঙালি হিন্দুদের জল ব্যবহারের আর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ধর্মীয় প্রাবল্য। সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়নের সূচনালগ্নে হিন্দুদের দ্বারা এবং হিন্দুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত টোল-পাঠশালা প্রভৃতির প্রসার দীর্ঘকাল যাবৎ হিন্দু-প্রধান এলাকায় প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। বিশেষ করে, ইংরেজ আমলে মুসলিমরা আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করায় মুসলিমরা আধুনিক শিক্ষা হতে পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। এগিয়ে যেতে থাকে হিন্দুরা। সাধারণ

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

মুসলিমরা মোঘল আমলের ন্যায় আরবি-ফারসি প্রভৃতি ভাষাতে এবতেদায়ি শিক্ষা গ্রহণ করে যেতে থাকে। মাদ্‌রাসায় পাঠদানকালে মৌলবিরা বাংলা শব্দ হিসেবে প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা শব্দরাশিই ব্যবহার করতেন। বাঙালি কবি-সাহিত্যিকগণের সাহিত্যকর্মেও হিন্দু কবি-সাহিত্যিকগণের তুলনায় আরবি-ফার্সি ভাষার প্রাধান্য ছিল। সংস্কৃত-প্রধান টোল বা পাঠশালার সঙ্গে মুসলিমদের এবতেদায়ি বা মাদ্‌রাসা শিক্ষার বৈপরীত্য ছিল প্রচুর। ফলে, মুসলিমরা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা সংস্কৃত হতে আগত তদ্ভব তথা প্রাকৃত ‘জল’ শব্দের ব্যবহারে সমধিক অভ্যস্থ হয়ে উঠে। অধিকন্তু, তখন বাংলা ভাষার প্রচার হিন্দু-প্রধান এলাকার বিদ্যালয়সমূহে যত ভালোভাবে করা হয়েছিল, মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় করা হয়নি; মুসলিমরাও প্রথমদিকে এদিকটাকে গুরুত্ব সহকারে নেননি। ফলে, মুসলিমরা আঞ্চলিক বা কথ্য ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেন।অন্যদিকে হিন্দুরা হয়ে উঠেন অধিকমাত্রায় সংস্কৃত-অনুসারী। বাংলা ব্যাকরণে সংস্কৃতের প্রভাবও এর অন্যতম একটি কারণ। কাজেই মুসলিমদের কাছে ‘পানি’ এবং শিক্ষিত হিন্দুদের কাছে ‘জল’ বহুল প্রচলিত হয়ে যায়। এভাবে শিক্ষিত হিন্দুদের ব্যবহারের কারণে সব হিন্দু এবং অমুসলিমরা জল শব্দ ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে যায়।

উপরের আলোচনা হতে দেখা যায়, ‘পানি’ ও ‘জল’ দুটোই সংস্কৃতজাত শব্দ। সংস্কৃত ‘পানীয়’ শব্দটি একটু পরিবর্তন হয়ে ‘পানি’ হয়েছে বলে হয়তো মুসলিমরা সরাসরি সংস্কৃত ‘জল’ না-বলে ‘পানি’ বলে থাকেন। হিন্দিভাষীগণ ‘পানি’ বলেন। বেশির ভাগ হিন্দিভাষী অমুসলিম। মুসলিমরাও বলে থাকেন পানি। সুতরাং উপমহাদেশে, ‘জল’ এর চেয়ে ‘পানি’ বলা লোকের সংখ্যা অধিক। তবে বাংলায় বিভিন্ন শব্দ ও প্রবাদ-প্রবচনে পানির চেয়ে জলের আধিক্য বেশি। ‘পানি’ দিয়ে গঠিত এবং বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে অন্তর্ভূক্ত শব্দের সংখ্যা মাত্র পাঁচ, কিন্তু ‘জল’ দিয়ে গঠিত শব্দের সংখ্যা একশ একচল্লিশ।এটিও বাংলা ব্যাকরণে সংস্কৃতের একছত্র প্রভাবের কারণে ঘটেছে। বাংলায় ব্যবহৃত আরবি শব্দ যে, হিন্দুরা ব্যবহার করেন না তা নয়। হিন্দুরা ‘আইন’, ‘কাগজ’, ‘কলম’ প্রভৃতির মতো আরও অনেক আরবি বা ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন, কিন্তু জল ও পানি কীভাবে হিন্দু মুসলিম হয়ে গেল- তা যথার্থভাবে বলা কষ্টসাধ্য।

আসলে, জল আর পানি একই জিনিসি। যেভাবে উদ্ভব হোক না কেন, শব্দের কোনো প্রাতিষ্ঠানক ধর্ম নেই। বাংলা অনেক শব্দে ‘জল’ আর পানি একসঙ্গে লেখা হয়। যেমন : ‘জলপানি। শব্দটির অর্থ: ছাত্রবৃত্তি, স্কলারশিপ, জলযোগের পয়সা প্রভৃতি। আর, যে ছাত্র ‘জলপানি’ পায় সে যে মেধাবী, তা কে না জানে? সুতরাং, যারা মেধাবী তাদের কাছে জলপানি, বা জল ও পানি অভিন্ন জিনিস। শব্দকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে টেনে আনা সমীচীন বলে মনে হয় না।

সূত্র. মোহাম্মদ আমীন, বাংলা ভাষার মজা, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

ওয়েবসাইট লিংকwww.draminbd.com

শুবাচ লিংক: #subach

 

Leave a Comment

রাজা বাদশা নবাব সম্রাট শাহেনশাহ সুলতান

. মোহাম্মদ আমীন

রাজা বাদশা নবাব সম্রাট শাহেনশাহ সুলতান

রাজাবাদশ: রাজা ও বাদশা শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ অভিন্ন। তবে প্রায়োগিক অর্থ ভিন্ন। ‘রাজা’ সংস্কৃত শব্দ এবং ‘বাদশাহ’ ফারসি শব্দ। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান (প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) অনুযায়ী ‘রাজা’ অর্থ দেশশাসক, নৃপতি, ভূপতি, পদবিশেষ, অতিশয় ধনিব্যক্তি, দাবাখেলার ঘুঁটিবিশেষ। ‘বাদশাহ’ শব্দের অর্থ মুসলমান সুলতান বা সম্রাট, রাজাধিরাজ। দুটো শব্দই শাসক অর্থ প্রকাশে ব্যবহৃত। হিন্দু শাসককে বলাহয় ‘রাজা’ এবং মুসলিম

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

শাসককে বলা হয় ‘বাদশাহ’। ‘রাজা’র চেয়ে ‘বাদশা’র শাসন অধিক্ষেত্র সাধারণভাবে ব্যাপক হতো। ছোটো ভুখণ্ড বা জনপদ নিয়েও রাজার অস্তিত্ব ছিল। প্রাচীনকাল হতে উপমহাদেশ, হিন্দুদের দ্বারা অর্থাৎ রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়ে আসছিল। এখানে ছোট ছোটো অনেক রাজ্য ছিল, যা রাজারাই শাসন করত।

নবাব: নবাব হচ্ছে নওয়াবার একটি শাব্দিক রূপ। নওয়াব শব্দটি আরবি নায়েব (প্রতিনিধি) শব্দের বহুবচন। তবে তা একবচন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।হিন্দি ভাষায় নওয়াব শব্দটির উচ্চারণ করা হয় নবাব। নবাব শব্দের সাধারণ আভিধানিক অর্থ, মুসলমান সামন্ত শাসক। এটি মুগল প্রাশাসনিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক পদমর্যাদা ও ক্ষমতা নির্দেশক একটি পদবিবিশেষ। ব্রিটিশ যুগে কোনো দপ্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট না-হয়েও ‘নবাব/নওয়াব’ রাষ্ট্রকর্তৃক সম্মানসূচক উপাধি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেকালে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা হিন্দি ভাষা দ্বারা সমধিক প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাই তারা সাধারণত হিন্দি রীতিতেই এটি উচ্চারণ করতেন। উনিশ শতকের বাঙালি লেখকগণ তাঁদের লেখায় ‘নওয়াব’ ও ‘নবাব’ উভয় শব্দই ব্যবহার করেছেন। এখনও শব্দ দুটি বাঙালিদের কাছে অভিন্ন অর্থ বহন করে।

কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে নওয়াব নিয়োগ করা হতো। কিন্তু পূর্ব ভারতের তিনটি প্রদেশে (বাংলা, বিহার ওউড়িষ্যা) নওয়াব নামে কোনো দাপ্তরিক পদ ছিল না। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এটি খেতাব হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মুগলদের অতিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় একই পদমর্যাদা সম্পন্ন পরস্পর স্বাধীন দুজন কর্মকর্তা সুবাহর (প্রদেশ বা কয়েকটি প্রদেশের সমষ্টি) শাসন পরিচালনা করতেন। এঁদের একজন ছিলেন সুবাহদার যিনি প্রশাসন এবং সেই সংঙ্গে বিচার ও প্রতিরক্ষা (এ দুটিকে একত্রে নিজামত বলা হতো এবং সুবাহদার নাজিম হিসেবে পরিচিত হতেন) ব্যবস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন এবং অন্যজন ছিলেন দীউয়ান যিনি রাজস্ব প্রশাসনের (দীউয়ানি) দায়িত্বে নিয়োজিত থাকতেন। এ দুজনই সম্রাট কর্তৃক সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত এবং সম্রাটের কাছেই দায়বদ্ধ ছিলেন।মুর্শিদকুলী খান থেকে শুরু করে সিরাজউদ্দৌলার সময় নওয়াবি যুগ নামে পরিচিত, যদিও তাঁদের কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে নওয়াব খেতাব গ্রহণকরেননি। দরবারে আগত অতিথিবর্গ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিকে নওয়াব হিসেবে নয়, নাজিম হিসেবেই সম্মান জানাতেন। যেহেতু ফরমান জারিকরা শুধু সম্রাটের এখতিয়ারভুক্ত ছিল। তাই নাজিমগণ পরওয়ানা জারি করতেন, ফরমান নয়। এদের প্রত্যেকেই প্রথাগতভাবে কেন্দ্র থেকে সুবাহদারি সনদ সংগ্রহ করতেন, যদিও তারা ছিলেন স্বাধীন। সমকালীন লেখক ও প্রত্যক্ষদর্শীরাও বরাবর তাঁদের নাজিম বা সুবাহদার বলে উল্লেখকরেছেন।

সম্রাট: সম্রাট (Emperor) সাধারণত কোনো একটি স্বাধীন দেশের শাসক কিংবা সাম্রাজ্যের অধীন কোনো রাজ্যের পুংলিঙ্গধারী রাজা বা শাসনকর্তা।প্রাচীন ফরাসি এম্পারিয়র শব্দটি ল্যাটিন ইম্পারেটর শব্দ থেকে আগত। সম্রাটের স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে সম্রাজ্ঞী ব্যবহৃত হয়। সাধারণত একজন সম্রাটের অবস্থান রাজার তুলনায় অধিকতর মর্যাদা সম্পন্ন এবং শীর্ষস্থানীয়।বর্তমান বিশ্বে কেবল জাপানেই সম্রাট পদবি রয়েছে।রাজা এবং সম্রাট – উভয়েই নির্দিষ্ট কোনো এলাকা বা রাজ্যের শাসনকর্তা হিসেবে ক্ষমতাসীন থাকেন। ইউরোপীয় মানদণ্ডে সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞী উচ্চপদস্থ ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত। তবে সাম্রাজ্যের অধীনস্থ রাজ্যের প্রধান হিসেবে সবসময় সম্রাট পদবি ব্যবহার করা হয় না। ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতে সম্রাট পদবির ব্যবহার হয়নি কিংবা যতটুকুই ব্যবহৃত হয়েছে তা

ড. মোহাম্মদ আমীন

সীমিত পর্যায়ে নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণপূর্বক করা হয়েছে।সম্রাটগণ রাজাদেরকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে ও কেবল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনীতিক সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে ক্ষমতাভার অর্পণ করেছেন।বর্তমানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে সম্রাট সরকার প্রধানের কর্মপরিধি ও সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

শাহেনশাহ: শাহেনশাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ শাহানশাহ, রাজাদের রাজা, রাজাধিরাজ। মুসলিম শাসনামলে, শাহ বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের পদবি হিসেবে ও ব্যবহৃত হয়ে থাকত। অনেক মুসলিমের নামও দেখা যায় শাহানশাহ বা শাহেনশাহ। শাহ ফারসি শব্দ। প্রাচীন পারসিক ভাষায় শব্দটির রূপ ছিল Xšâyathiya ‘রাজা’। পারসিক ধর্মগ্রন্থ আবেস্তায় এটি ছিল xšaΘra-, “রাজশক্তি বা সমরশক্তি”। প্রাচীন সংস্কৃত kṣatra (ক্ষত্র) থেকে ক্ষত্রিয় (যোদ্ধা) শব্দের উদ্ভব। আধুনিক ফারসি ভাষায় শাহ অর্থ বাদশাহ বা রাজা। ভারতবর্ষের সুলতানি আমলের শাসকেরা এবং মোগল শাসকেরা নিজেদের নামের সাথে শাহ পদবি ব্যবহার করতেন। অনেকে এই পদবির সঙ্গে শাহেন লাগিয়ে বলতেন শাহেনশাহ।তবে এটি ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক পদবি। পীর, দরবেশদের নামের পদবিতেও শাহ ও শাহেনশাহ এর বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়।

সুলতান: সুলতান আরবি উৎসের শব্দ। এর অর্থ (বিশেষ্যে) বাদশাহ, রাজা। তুরস্কের পূর্বতন নৃপতি বা শাসকদের সুলতান বলা হতো। অর্থাৎ, বাদশা, রাজা ও সুলতান সমার্থক। সুলতানি ফারসি শব্দ। সুলতানের পদ বা দায়িত্বকে বলা হয় সুলতানি। নবাব  প্রাদেশিক শাসনকর্তা। সুলতান বা রাজা-বাদশার অধীন প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে নবাব বলা হয়।

 #subach

উৎস: বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

Leave a Comment

লক্ষ লক্ষ্য উপলক্ষ উপলক্ষ্য

ড. মোহাম্মদ আমীন

লক্ষ লক্ষ্য উপলক্ষ উপলক্ষ্য

আমার লক্ষ্য ছেলেটির প্রতি লক্ষ রেখে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া-এই উপলক্ষ্যে আজকের এ আয়োজন। উপরের বাক্যটি লক্ষ করলে বুঝবেন, ‘লক্ষ’ আর ‘লক্ষ্য’ অর্থে অভিন্ন নয়। মূলত ‘লক্ষ’ ও ‘লক্ষ্য’ দুটি ভিন্ন শব্দ। যেমন অর্থে তেমন বানানে। তবে উচ্চারণ অভিন্ন, তাই গন্ডগোলটা আরও বেশি হয়। শব্দ-দুটোর

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অর্থ, আচরণ এবং দ্যোতনাগত পার্থক্য রয়েছে।তেমনই পার্থক্য রয়েছে ‘উপলক্ষ’ আর ‘উপলক্ষ্যে’। সংখ্যাবাচক পদ হিসাবে ‘লক্ষ’ শব্দের বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। অঙ্ক বা সংখ্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে সর্বদা ‘লক্ষ’ বসবে। যেমন : দশ লক্ষ টাকা দিয়ে গাড়িটা কেনা হলো। আবার ‘খেয়াল রাখা’ প্রকাশেও ‘লক্ষ’ ব্যবহার করা হয়। এটি তখন ক্রিয়াপদ। যেমন : আমার লক্ষ্য ছেলেটির প্রতি লক্ষ রেখে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া।‘লক্ষ’ করার যোগ্য বা ‘লক্ষ’ করার বস্তু অর্থে, অর্থাৎ বিশেষ্য ও বিশেষণে ‘লক্ষ’ই একমাত্র বানান। যেমন :  লক্ষ না-থাকায় লক্ষ টাকা বেহাত হয়ে গেল। অঙ্ক বা সংখ্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে সর্বদা ‘লক্ষ’ বসবে।  যেমন :“যে মাটির বুকে লুকিয়ে আছ লক্ষ মুক্তি সেনা/ দে না, তোরা দে না, সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দে না।”  আবার ‘খেয়াল রাখা’ প্রকাশেও ‘লক্ষ’ ব্যবহার করা হয়। এটি তখন ক্রিয়াপদ। যেমন : ছাত্রছাত্রীদের প্রতি ‘লক্ষ’ রাখো।

সংস্কৃত ‘লক্ষ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বিশেষ্যে খেয়াল করা, শতসহস্র সংখ্যা, লাখ এবং বিশেষণে শতসহস্র সংখ্যক, অসংখ্য, সংখ্যাতীত। এবার ‘লক্ষ’ শব্দের পদার্থ দেখা যাক:

  1. খেয়াল করা : শিশুটির প্রতি ‘লক্ষ’ রেখো।
  2. শতসহস্র সংখ্যা, লাখ : একশ হাজারে এক লক্ষ।
  3. অসংখ্য, সংখ্যাতীত : লাখ লাখ মানুষ পথে নেমে এসেছে।।

বিশেষ্য বা বিশেষণ হিসাবে ব্যবহার করা হলে ‘লক্ষ’ বানানে ‘য-ফলা’ (লক্ষ্য) ব্যবহার করতে হয়, কিন্তু ক্রিয়াপদ ও সংখ্যাবাচক পদ হিসাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘য-ফলা’ ব্যবহার বিধেয় নয়। যেমন : নেতার লক্ষ্য দেশের উন্নয়নের প্রতি লক্ষ রাখা, কেবল নিজের প্রতি লক্ষ রাখা নয়। এই বাক্যে ‘লক্ষ্য’ পদটি কর্তার উদ্দেশ্য, তাক ও কাম্য বিষয়কে দ্যোতিত করছে। অন্যদিকে, ‘লক্ষ’ পদটি খেয়াল রাখা প্রকাশ করছে।  সাধারণত উদ্দেশ্য প্রকাশের জন্য ‘লক্ষ্য’ ব্যবহার করা হয়।যেমন :

“যদি লক্ষ্য থাকে অটুট,

বিশ্বাস হৃদয়ে; হবে হবেই দেখা, দেখা হবে বিজয়ে।”

‘লক্ষ্য’ শব্দের আভিধানিক অর্থ উদ্দেশ্য, তাক (target), কাম্য বস্তু বা বিষয় এবং বিশেষণে লক্ষণাশক্তির দ্বারা জ্ঞাতব্য, উদ্দিষ্ট, জ্ঞেয় প্রভৃতি। নিম্নের বাক্যসমূহে ‘লক্ষ্য’ শব্দের পদার্থ দেখুন:

  • উদ্দেশ্য : লক্ষ্য আমার বিসিএস।
  • টার্গেট : লক্ষভ্রষ্ট হয়েছে আঘাত।
  • তাক : সরকারের উদ্দেশ্য আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে শহরকে ভিক্ষুকমুক্ত করা।
  • কাম্য বস্তু বা বিষয় : উদ্দেশ্য অর্জনে পিছপা হওয়া চলবে না।

সংস্কৃত ‘উপলক্ষ্য’ শব্দের অর্থ বিশেষ্যে– উদ্দেশ্য, প্রয়োজন, অবলম্বন, ব্যাপদেশ, ঘটনাক্রম এবং বিশেষণে উদ্দিষ্ট, প্রয়োজনীয় প্রভৃতি। অর্থ হতে বোঝা যায়,

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

উপলক্ষ্য শব্দের সঙ্গে লক্ষ্য শব্দের অর্থগত মিল আছে এবং অনেক ক্ষেত্রে উভয় শব্দ সমার্থক। লক্ষ্য শব্দের পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে উপলক্ষ্য লেখা যায়। যেমন : আমাদের উপলক্ষ্যে কেউ বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারবে না। আমাদের লক্ষ্যে কেউ বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারবে না।

উপলক্ষ্য = উপ + লক্ষ্য; লক্ষ্য এর উপ বা সহকারী যে; আশ্রয়, অবলম্বন, প্রয়োজন, উদ্দেশ্য, অভিপ্রায়, ব্যাপদেশ, ছল, ছুতা, occasion বা আয়োজন অর্থে

প্রচলিত। এসব অর্থ যেখানে নিহিত, সেখানে অবশ্যই উপলক্ষ্য হবে, উপলক্ষ নয়। উদ্দেশ্য ও উদ্দেশ শব্দের মতো ‘লক্ষ’, ‘লক্ষ্য’, ‘উপলক্ষ’ ও ‘উপলক্ষ্য’ শব্দের বানান এবং প্রয়োগ নিয়েও বিভ্রাট দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে ‘চক্ষু বা মনশ্চক্ষুর’ দ্বারা কোনও কোনও বস্তু বা বিষয়কে নিজের মধ্যে নেওয়া বা লওয়ার কাজটি দিশাগ্রস্ত থাকে যাতে, তাকে লক্ষ বলা হয়। এ লক্ষ যাতে থাকে সেটিই হচ্ছে লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রীদের উদ্দেশে বললেন, সবার প্রতি লক্ষ রাখাই আমার লক্ষ্য।  সংগতকারণে উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য ভিন্ন অর্থ ধারণ করে। অনেকে লিখেন, “স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান।” এটি ভুল, শুদ্ধ হবে, “স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠান।”

‘উপলক্ষ’ হচ্ছে ‘লক্ষ’ এর সহকারী অন্যদিকে ‘উপলক্ষ্য’ হচ্ছে ‘লক্ষ্য’ এর সহকারী। লক্ষ্য থাকলেই উপলক্ষ্য থাকতে পারে কিন্তু লক্ষ থাকলে উপলক্ষের সম্ভবান খুবই ক্ষীণ। সে কারণে ‘উপলক্ষ’ শব্দটির প্রয়োগ প্রায়শ ত্রুটিপূর্ণ হয়। তাই ‘উপলক্ষ’ শব্দটি না-লেখাই সমীচীন। বাংলাভাষীগণ শব্দটি যেভাবে প্রয়োগ করেন, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে শব্দটি আসলে ‘উপলক্ষ্য’কেই বোঝায়; ভুল বানানের কারণে সেগুলো ‘য’ফলাহীন হয়ে রয়েছে। এজন্য বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘উপলক্ষ’ শব্দটি রাখাই হয়নি।

লক্ষ্য উপলক্ষ্য নিয়ে এবার একটি কথোপকথন

জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত ফুটবলে ম্যাচে শান্তিনিকেতনের ছেলেরা আট-শূন্য গোলে জিতেছে। অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশি খেলোয়াড়দের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কক্ষের উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন, লক্ষ্য ছেলেদের উৎসাহ প্রদান। 
খেলোয়াড়দের লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ  বললেন, কেমন হলো খেলা?
দলনেতা বলল, গুরুদেব, আমাদের দল জিতেছ। লক্ষ্য আমাদের অর্জিত হয়েছে।
কয়গোল দিয়েছ? রবীন্দ্রনাথ বললেন।
আমরা তাদের আট গোলে হারিয়ে দিয়েছি।
রবীন্দ্রনাথ দলনেতার কথা শুনে মুচকি হেসে বললেন, জিতেছ ভালো, তোমাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে, উপলক্ষ্য সার্থক হয়েছে; তা বলে আট গোল কেন? এ কী করলে তোমরা!
গুরুদেব, কম হয়ে গেছে না কি? প্রমথনাথ বিশি জানতে চাইলেন।
রবীন্দ্রনাথ মুচকি হাসিটাকে মুখটি হাসিতে পরিব্যপ্ত করে বললেন, ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে, না কি।

#subach

উৎস

  • কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।
  •  ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

Leave a Comment

সর্বজনীন ও সার্বজনীন: সর্বজনীন বনাম সার্বজনীন

ড. মোহাম্মদ আমীন

সর্বজনীন ও সার্বজনীন: সর্বজনীন বনাম সার্বজনীন

 ‘সর্বজনীন’ ও ‘সার্বজনীন’ দুটোই শুদ্ধ কিন্তু অর্থ ভিন্ন। একটি বিশেষ্য এবং অন্যটি বিশেষণ। অনেকে ‘সর্বজনীন’ অর্থে ‘সার্বজনীন’ লিখে থাকেন। অর্থ না-জানার জন্য এমন হয়ে থাকে। লেখার সময় কোনটি লিখবেন, এ নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হলে ‘সর্বজনীন’ লিখুন।তা হলে অন্তত ভুল হওয়ার আশঙ্কা বহুলাংশে কমে

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

যাবে। কারণ, সাধারণত যে অর্থে ‘সার্বজনীন’ লেখা হয় নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে সেটি ওই অর্থ-প্রকাশে যথোচিত নয়, বরং ‘সর্বজনীন’ শব্দই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপযুক্ত। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেব ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘সর্বজনীন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ, সর্বসাধারণের জন্য অনুষ্ঠিত, বারোয়ারি, সর্বসাধারণের সহায়তায় কৃত, সকলের জন্য মঙ্গলকর বা কল্যাণকর, সবার জন্য হিতকর, সবার মঙ্গলের জন্য কৃত, সকলের জন্য উদ্দিষ্ট। যেমন : ভালোবাসা সর্বজনীন বিষয়। ফল সর্বজনীন খাদ্য। মানবাধিকার সর্বজনীন অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। কোনো ধর্মের অবতারই সর্বজনীন নয়।

বাক্যে বিশেষণ হিসেব ব্যবহৃত ‘সার্বজনীন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘সবার মধ্যে প্রবীণ, জ্যেষ্ঠ’। যেমন: ‘ জিম্বাবুয়ের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রবার্ট মুগাবে ( জন্ম ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি ) সার্বজনীন নেতা।’ [ কারণ ৯৪ বছর বয়সি এ রাষ্ট্রনায়কের চেয়ে অধিক বয়স্ক নেতা বিশ্বে আর কেউ নেই।] অবশ্য প্রবীণ শব্দটি ‘শ্রেষ্ঠ’ অর্থ প্রকাশে ব্যবহার করা হলে সেক্ষেত্রে ‘সার্বজনীন’ শব্দের অর্থ সম্প্রসারিত হয়। যেমন : ‘নেলসন মেন্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার সার্বজনীন নেতা। কিন্তু ‘শ্রেষ্ঠ’ অর্থে ‘সার্বজনীন লেখা সমীচীন নয়। কারণ ‘শ্রেষ্ঠ’ প্রকাশের জন্য বাংলায় অনেক যুতসই ও বিকল্প শব্দ রয়েছে। ফলে, ‘নেলসন মেন্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বজনীন নেতা‘ লেখাই বিধেয়। সবার জন্য প্রযোজ্য, সবার জন্য হিতকর প্রভৃতি অর্থে ‘সার্বজনীন’ লেখা ঠিক নয়।

‘সার্বজনীন দুর্গাপূজায় আপনাকে স্বাগত’। এর অর্থ সবার মধ্যে প্রবীণ বা সবার মধ্যে জ্যেষ্ঠ দুর্গাপূজায় আপনাকে স্বাগত। কথাটির যৌক্তিকতা কতটুকু তা পরের বিষয়। তবে এখানে ‘সার্বজনীন’ বলার চেয়ে, ‘সর্বজনীন’ বলাটাই যে উত্তম হতো – এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং ‘সবার জন্য হিতকর, সবার জন্য প্রযোজ্য বা সবার জন্য কল্যাণকর প্রভৃতি অর্থে সার্বজনীন তথা ‘সকলের মধ্যে প্রবীণ বা জ্যেষ্ঠ’ বলা বিধেয় নয়। তাই সবার জন্য হিতকর, সবার জন্য প্রয়োজ্য, সবার জন্য কল্যাণকর প্রভৃতি অর্থ প্রকাশে ‘সর্বজনীন’ লেখা উচিত। যেমন: সর্বজনীন উৎসব।

#subach

উৎস: কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

দেখুন: আহমদ ছফার করুণ মৃত্যু

 

Leave a Comment

বাঙালি মুসলমানের নাম

ড. মোহাম্মদ আমীন

বাঙালি মুসলমানের নাম

ব্যক্তিনাম কী- তা আমরা জানি; কিন্তু ইসলামিক ব্যক্তিনাম কী- তা নিয়ে অনেকের সংশয় থাকতে পারে। অথচ এটিই  এ আলোচনার মুখ্য বিষয়। অতএব, আলোচনার প্রারম্ভে দেখে নিই ইসলামিক ব্যক্তিনাম’ নাম কী? প্রথমেই বলে রাখি, কাউকে অনুসরণ না-করে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের আলোকে উপমহাদেশের প্রাসঙ্গিকতায় আমি এর সংজ্ঞার্থ পরিবেশন করব। আমার সংজ্ঞার্থের সঙ্গে সবাই ঐকমত্য পোষণ করবেন- এমনটি হয় না এবং আমিও তা চাই না। আপনার ভিন্নমত আমার মতকে ঋদ্ধ করবে- এটি আমি নিশ্চিত বলতে পারি। তবে অযথা কটূক্তি করবেন না, কিংবা অহেতুক ধর্মকে টেনে আনবেন না, ইতিহাসকে উপেক্ষা করে শুধু বিশ্বাস-নির্ভর কোনো মন্তব্য করবেন না। কারণ, আমার মত গ্রহণে কেউ বাধ্য নন বা আমিও কাউকে বাধ্য করছি না। এবার আমার সংজ্ঞার্থটি দেখে নেওয়া যায় : মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষত আরবি ভাষাসম্পৃক্ত কিংবা যে ভাষারই হোক না কেন, আরবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শব্দ দ্বারা রাখা ব্যক্তিনামগুলো উপমহাদেশে ইসলামিক ব্যক্তিনাম হিসেবে পরিচিত। এ ভাষাসমূহের মধ্যে আরবি, ফারসি, হিব্রু ও তুর্কি প্রধান। অনেকের কাছে এ ভাষাসমূহের শব্দ দিয়ে রাখা নাম আরবীয় নাম হিসেবেও পরিচিত। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের ভাষাগুলো ষষ্ঠ শতকে ইসলামের আবির্ভাবের বহু পূর্ব হতে চলে আসছে।

ষষ্ঠ শতকে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে অর্থাৎ প্রাক-ইসলামিক যুগে মাতৃভাষা অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যের লোকদের নাম রাখা হতো আরবি, হিব্রু ও ফারসি এবং

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

সীমিত মাত্রায় তুর্কি প্রভাবিত। তখন ইসলাম ধর্ম ছিল না বলে আরবি নামের ব্যক্তিবর্গ মুসলিম ছিলেন না। আবুবকর, ওমর, ওসমান, আলী, হামজাহ, হায়দার, আবু তালিব, আবদুল্লাহ, আবু লাহাব, আবু জাহেল, আবু সুফিয়ান, হাফসা, সায়েফা, আমেনা, খাদিজা, মরিয়ম প্রভৃতি আরবীয় নাম হলেও ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এমন নামধারীদের কেউ মুসলিম ছিলেন না, তারা ছিলেন প্রস্তরপূজক এবং অন্যান্য স্থানীয় ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী।

অথচ ইসলামের আবির্ভাবের পর এই নামগুলোই হয়ে উঠে  মুসলিম নাম এবং অনেকে হয়ে উঠেন খ্যাতিমান মুসলিম। কিন্তু তাদের কেউ অমুসলিম থাকাকালীন পূর্বের নাম পরিবর্তন করেননি, করার চিন্তাও করেননি। কারণ, মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন আরবি ভাষায় লিখিত। তাই ধর্ম পরিবর্তন হলেও তাদের মাতৃভাষাটাই ধর্মীয় ভাষার স্থান নিয়ে নিয়েছিল। অন্যদিকে, পারসিক কবি ফেরদৌসির শাহনামার অন্যতম চরিত্র সোহরাব, রুস্তম ও তাহমিনা ছিলেন অগ্নি উপাসক, ইবরাহিম-ইয়াকুব, মুসা প্রমুখ ছিলেন ইহুদি। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে এসব নাম মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ব্যক্তিনাম। কারণ  এ নামগুলোর সঙ্গে আরবি ভাষার গভীর নৈকট্য রয়েছে। সুতরাং এটি সর্বজনবাদীস্বীকৃত যে, মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীদের ব্যক্তিনাম ধর্মগত নয়, বরং ভাষাগত ও স্থানপ্রভাবিত। এর কারণ, ওই অঞ্চলের প্রধান ভাষায় (আরবি) কুরআন লিখিত হয়েছে। তাই তাদের ব্যক্তি নামের সঙ্গে ধর্মীয় নামের কোনো সংঘর্ষ ঘটেনি, ফলে ভাষাগত নাম ব্যক্তিনামে এবং ব্যক্তিনাম ধর্মগত নামে আর উভয় কারণ স্থানিক সংস্কৃতে  একাকার হয়ে গেছে। উপমহাদেমের মুসলিমের ক্ষেত্রে তেমন ঘটার কি সুযোগ ছিল?

কাগজে একজন লোকের নাম লেখা আছে Ameen। নামের পর জানা গেল তিনি উমহাদেশের লোক। এই দুটি তথ্য দ্বারা Ameen নামের লোকটির ধর্মীয় পরিচয় বহুলাংশে নিশ্চিত হওয়া যায়। যদিও তার জাতীয়তা বা ভাষা সম্পর্কে মোটেও নিশ্চিত হওয়া যায় না। যদি Ameen নামের লোকটির জন্ম-এলাকা অজ্ঞাত থাকত তাহলে শুধু `Ameen’ নাম দিয়ে তার ধর্ম, জাতীয়তা ও ভাষা কোনোটাই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হতো না। কারণ, পৃথিবীতে ‘Ameen’ নামের অনেক মুসলিম আছে, অনেক ইহুদি আছে, অনেক খ্রিষ্টানও আছে। যদি বলা হয়, Muhammed  Ameen , তাহলে এ নামের দ্বারা লোকটির ধর্ম বহুলাংশে নিশ্চিত হওয়া যায়, যদিও তার জাতীয়তা বা ভাষা সম্পর্কে মোটেও নিশ্চিত হওয়া যায় না। কেননা, পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের বিভিন্ন দেশে এ নামের অসংখ্য মুসলিম রয়েছে।

আর একটা বিষয়, উপমহাদেশে Muhammed শব্দটাকে মোহাম্মদ, মুহাম্মদ, মুহম্মদ, মোহাম্মেদ, মো. মোহাং, এমডি,  মোহাম, মু, মুহা – অসংখ্য রূপে লেখা হয়। এরূপ ভিন্ন হওয়ার কারণ হচ্ছে স্কুলে যারা মুসলিম সন্তানদের নাম নিবন্ধন করতেন, তাদের প্রায় সবাই ছিলেন অমুসলিম, বিশেষত হিন্দু। সুতরাং তাদের Muhammed নামের বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা  ছিল না। থাকলেও কেউ   কেউ লেখার স্থান কমানোর অজুহাতে অথবা অনেকে ‘শ্রী’ শব্দের পরিবর্তে এটি বসানো হচ্ছে ধরে নিয়ে Muhammed শব্দকে মো. মোহাং, মোহ. Md প্রভৃতি ইচ্ছেমতো শব্দ বসিয়ে দিতেন। অধিকাংশ মুসলিম সন্তানের পিতা নিরক্ষর ছিলেন বলে অমুসলিম শিক্ষকদের   ইচ্ছা বা কাজের ওপর মন্তব্য করার মতো সামান্য যোগ্যতাও তাদের ছিল না। তাই নির্বিবাদে মেনে নিতেন। প্রমিতা দাস লাবণী একটি ব্যক্তি নাম। এ নাম শুনে তার ধর্মীয় পরিচয় এবং একই সঙ্গে জাতীয়তা, ভাষা ও সংস্কৃতি বহুলাংশে নিশ্চিত হওয়া যায়। এজন্য তার জন্ম-এলাকা জানার প্রয়োজন পড়বে না। অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই বলে দিতে পারবেন- প্রমিতা দাস লাবণী বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মহিলা। এখানে তার বাংলা নাম ও পদবি তার পরিচিতির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। তেমনি, রমণী মোহন আচার্য্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রভাত কুমার স্যানাল, চন্দন দত্ত  প্রভৃতি।

আমার এক সহকর্মীর নাম শাহ উছমান ইবনে শামস। তিনি কী মুসলিম? অনেকে বলবেন, মুসলিম। তার জন্ম উপমহাদেশে হলে বলা যেত তিনি মুসলিম। কিন্তু তার বাড়ি উপমহাদেশে নয়। আসলে, তিনি একজন ইরানিয়ান ইহুদি, কিন্তু মাতৃভাষা আরবি (ইরানিয়ানদে সাধারণ মাতৃভাষা ফারসি) বলে তার নাম আরবীয়। আবির (Abir) একটি প্রসিদ্ধ হিব্রু শব্দ, যার অর্থ শক্তিশালী।বাংলায় আবির একটি রঙ। ইব্রাহিম একটি প্রসিদ্ধ হিব্রু ও আরবীয় নাম- কুরআনেও নামটি রয়েছে। সারা, সারাহ (প্রিন্সেস), মরিয়ম, মায়মুনা প্রভৃতি ইহুদীয় হিব্রু শব্দ, কুরআনে ‘মরিয়ম’ নামের একটি সুরাও রয়েছে। কিন্তু মধ্যাপ্রাচ্য-সহ পৃথিবীর অনেক দেশে এসব নামের অনেক মুসলিম দেখা যায়। কারণ এসব শব্দরাজি মধ্যপ্রাচ্যের ভাষা থেকে আগত।

আমার এক খালার নাম মরিয়ম এবং আরেক খালার নাম হোসানা-দুটিই হিব্রু শব্দ; দুজনের নাম হ্রিব্রু- ইহুদীয় ভাষা; কিন্তু তারা কেউ ইহুদি নন। তবে মধ্যপ্রাচ্যের নাম এবং একই সঙ্গে আরবীয়-প্রকৃতির বলে উপমহাদেশে এসব নাম ইসলামিক নাম হিসেবে পরিচিত। তবে মধ্যপ্রাচ্যে কোনো নামই ইসলামিক নাম নয়, আরবীয় নাম। আর একটা নাম দেখা যাক; আমার স্ত্রীর নাম এ্যনি (Anee)। হিব্রু ভাষায় শব্দটির অর্থ Gracious. আমার সিনিয়র এক বিখ্যাত মৌলানা কন্যার নামও এ্যানি, তিনি এখন সৌদি আরবের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরবি পড়ান। নাম দুটো মধ্যপ্রাচ্যের ভাষার হলেও আরবীয়-প্রকৃতির নয় বলে অনেকে মনে করেন- এটি খ্রিষ্টানীয় নাম।

বাবুল, দুলাল, জয়, মিন্টু, টুটুল, মিল্টন, লিংকন, রানা, সজল, সজীব, চয়নিকা, অথৈ, প্রতীতি, স্নিগ্ধা বৃষ্টি, শান্তা, রেখা প্রভৃতি এখন উপমহাদেশের বহুল প্রচলিত কয়েকটি নাম। পুরো না-শুনলে কেবল এসব নাম দিয়ে নামধারীর ধর্ম, ভাষা ও জাতীয়তা কোনো কিছু নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ উপমহাদেশে বর্ণিত নামসমূহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে দেখা যায়। আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধুর নাম ছিল বাবুল, সে ছিল হিন্দু। বাবুল নামের আমার অনেক মুসলিম সহকর্মী ও ছাত্র আছে।

সুতরাং, উপমহাদেশে বাঙালি মুসলিমদের নাম ভাষাগত নয়, পুরোপুরি ধর্মগত। কেন তা ব্যাখ্যা করছি : সপ্তদশ শতকের প্রথম দিক থেকে উপমহাদেশের সঙ্গে মুসলিম তথা আরবদের পরিচয় নিবিড় ও বিস্তৃত হতে থাকে। এরপর থেকে উপমহাদেশের সঙ্গে ইসলামিক নামের পরিচয় ঘটে। আরবদের সংস্রবে আসার

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

ফলে উপমহাদেশের যেসব অমুসলিম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেন, তাদের অস্পৃশ্য, ধর্মত্যাগী, পাপিষ্ঠ, একঘরে, কুলাঙ্গার প্রভৃতি নাম দিয়ে প্রাক্তন সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হতো। তাদের হত্যা করা হতো, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। ফলে নব্য-মুসলিমরা প্রাক্তন সমাজ হতে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচার জন্য আরবীয়দের উপর এতই নির্ভরশীল হয় পড়ত যে, নিজের পুরানো নামটাও বদলে নেওয়াকে পুণ্যের বা গৌরবের মনে করত। প্রাক্তন সমাজ ব্যবস্থাকে প্রচণ্ড ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করে চলে আসত নতুন জগতে।

এভাবে, উপমহাদেশে ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে তত প্রবল হতে থাকে তাদের ধর্মীয় বোধ। পূর্বতন সমাজ থেকে বিতাড়িত ও বিচ্ছিন্ন এসন নও-মুসলিরা মাতৃভাষার আবহে ইসলাম ধর্মীয় নেতাদের নির্দেশনায় গড়ে তোলে একটি নতুন সমাজ। আরবীয়দের ধর্মীয় প্রভাবের কারণে উপমহাদেশের নও মুসলিমগণ যুগের পর যু আচরিত ধর্ম আর সংস্কারকে ছুড়ে ফেলে আরবীয়দের শিক্ষাকে পরম পবিত্রতায় গ্রহণ করে। তাদের কাছে  আরবী ভাষা দেবভাষা সংস্কৃতের চেয়ে আরো প্রবল ও পবিত্র হয়ে উঠে। এটি কেমন প্রবল ছিল তা একটি ঘটনা দিয়ে তুলে ধরা যায়: 

 আব্বাস প্রথম সৌদি আরব এলেন শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য। বিশ বছর যাবৎ সৌদি আরবে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত হামিদ তাকে বিমান বন্দর থেকে নিতে এসেছে।  জেদ্দা বিমান বন্দর থেকে  বের হয়ে আসার পর পথে একটি আরবি লেখা পত্র দেখলেন। অনেক লোক কাগজটি পা দিয়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে। আব্বাস পরম শ্রদ্ধাভরে কাগজটি  ‍তুলে নিয়ে কপালে ছুঁইয়ে  চুমোর পর চুমো দিয়ে শুরু করে।  আব্বাসকে একটি কাগজে এমন পাগলের মতো  চুমো খেতে দেখে হামিদ  বলল, এটি কী? আব্বাস বলল, “আরবি লেখা  কাগজ। ফুটপাতে পড়েছিল। লোকে পা দিয়ে মাড়িয়ে পাপ করছে। তাই তুলে নিয়ে চুমো খাচ্ছি, সওয়াব হয়ে গেল।” হামিদ ছিন্ন পত্রটি পাঠ করে বলল, শুনবে কী লেখা আছে ?  কী?  হামিদ বলল, গালাগালি দিয়ে লেখা চিঠি।

সংগত কারণে উপমহাদেশের মুসলিমদের ধর্ম, তাদের প্রাক্তন সমাজ,সংস্কৃতি ও ভাষার চেয়ে পবিত্র হয়ে যায়। এভাবে ধীরে ধীরে আরবীয় নামগুলো উপমহাদেশে ভাষাগত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে সম্পূর্ণ ধর্মগত হয়ে পড়ে।এ কারণে উপমহাদেশে প্রথমদৃষ্টে নামই হয়ে পড়ে ধর্ম-পরিচিতির প্রথম চিহ্ন। এভাবে বাঙালি মুসলমানের এবং একই সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের নাম রাখার ক্ষেত্রে  মাতৃভাষা সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে। 

#subach

Leave a Comment

শব্দের মাঝে বিসর্গ: কখন কোথায় কেন

ড. মোহাম্মদ আমীন

শব্দের মাঝে বিসর্গ: কখন কোথায় কেন

শব্দের মাঝখানে থাকা বিসর্গের উচ্চারণ ‘কখনো হসন্ত বা খণ্ড-ত’ এর মতো হয়। যেমন: ইতঃপূর্বে (উচ্চারণ- ইতোহ্‌প্‌পুর্‌বে)। আবার কখনো বিসর্গের প্রভাবে পরবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণটি দ্বিত্ব লাভ করে। যেমন: দুঃখ (দুখ্‌খো); নিঃসঙ্কোচ (নিশ্‌শঙকোচ), দুঃসংবাদ (দুস্‌সঙবাদ) ইত্যাদি। বানানে সংশয় ও উচ্চারণ জটিলতা এড়ানোর সুবিধার্থে শব্দের মধ্যাংশে বিসর্গযুক্ত কয়েকটি শব্দের তালিকা এখানে দেওয়া হলো। এগুলো জানা থাকলে শব্দের মধ্যাংশে বিসর্গজনিত বানান-ভুলের মাত্রা বহুলাংশে কেটে যাবে। যেমন :

অতঃপর, অধঃক্রম, অধঃকৃত, অধঃক্ষেপণ, অধঃপতন, অধঃস্থিত, অধঃস্থ, অধঃশিখা, অধঃপতিত, অন্তঃক্রীড়া, অন্তঃকোণ, অন্তঃকুটিল, অন্তঃকরণ,

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অন্তঃকলহ, অন্তঃপট, অন্তপাতী, অন্তঃপুর, অন্তঃপুরচারী, অন্তঃপুরবাসিনী, অন্তঃপুরিকা, অন্তঃরাষ্ট্রিক, অন্তঃশত্রু, অন্তঃশীলা, অন্তঃশুল্ক, অন্তঃসংগতি, অন্তঃসংজ্ঞা,অন্তঃসত্তা, অন্তঃসত্ত্বা, অন্তঃসলিল, অন্তঃসলিলা, অন্তঃসার, অন্তঃসারবিহীন, অন্তঃসারশুন্য, অন্তঃস্থ, অন্তঃস্থিত; ইতঃপর, ইতঃপূর্বে; উচ্চৈঃস্বরে;

চক্ষুঃশূল, চতুঃশাখা, চতুঃশালা, চতুঃসীমা, ছন্দঃপতন, ছন্দঃপাত, ছন্দঃশাস্ত্র; জ্যোতিঃশাস্ত্র, জ্যোতিঃপুঞ্জ,জ্যোতিঃপূর্ণ, জ্যোতিঃপ্রভা; তপঃপ্রভাব, তপঃক্লেশ, তেজঃপুঞ্জ; দুঃশাসন, দঃশীল, দুঃসংবাদ, দুঃসময়, দুঃসহ, দুঃসাধ্য, দুঃসাহস, দুঃসাহসিক, দুঃস্থ, দুঃস্বপ্ন;

নিঃশ্বাস, নিঃশ্বেসন, নিঃশেষ, নিঃশর্ত, নিঃশব্দ, নিঃসীম, নিঃসৃত, নিঃস্পৃহ, নিঃস্রাব, নিঃস্নেহ, নমঃশূদ্র, নিঃশক্তি, নিঃশঙ্ক, নিঃশত্রু, নিঃসারণ, নিঃসাড়, নিঃসহায়, নিঃসরণ, নিঃসম্বল, নিঃসম্পাত, নিঃসন্ধিগ্ধ, নিঃসন্দেহ, নিঃসন্তান, নিঃসত্ত্ব, নিঃসঙ্গ, নিঃসংশয়, নিঃসংকোচ, নিঃশ্রেণি, নিঃশ্মশ্রু, নিঃস্ব, নিঃস্বত্ব, নিঃস্বর, নিঃস্বার্থ, নিঃস্বীকরণ, নিঃস্রোতা;

প্রাতঃকাল, প্রাতঃকৃত্য, প্রাতঃক্রিয়া, প্রাতঃস্মরণীয়, প্রাতঃস্নান, পয়ঃপ্রণালী, পুনঃপুন, পুনঃপ্রবেশ, পৌনঃপুনিক, প্রাতঃপ্রণাম, প্রাতঃসন্ধ্য; মনঃপ্রাণ; বয়ঃকনিষ্ঠ, বয়ঃক্রম, বক্ষঃস্থল, বহিঃস্থ, বহিঃসমুদ্র, বহিঃশুল্ক, বহিঃশত্রু, বহিঃপ্রকাশ, বয়ঃস্থ, বয়ঃসন্ধি, বয়ঃপ্রাপ্ত;

মনঃশিলা, মনঃসংযোগ, মনঃস্থ, মনঃসমীক্ষা, মনঃসমীক্ষণ, মনঃসংযোগ, মনঃপূত, মনঃপীড়া, মনঃক্ষোভ, মনঃক্ষুণ্ন, মনঃকষ্ট, মনঃকল্পিত; যশঃকীর্তন; শিরঃপীড়া, শিরঃশূল; সদ্যঃকৃত, সদ্যঃপক্ব, স্বতঃসিদ্ধ, স্বতঃস্ফূর্ত, স্রোতঃপথ, সদ্যঃপ্রবিষ্ট, স্বতঃপ্রণোদিত, স্বতঃপ্রমাণিত।

#subach

উৎস: কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

Leave a Comment

অরণ্য বন ও জঙ্গল: নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা

ড. মোহাম্মদ আমীন

অরণ্য বন ও জঙ্গল: নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘অরণ্য’ শব্দের অর্থ গাছপালায় ঢাকা জায়গা যেখানে বন্য পশু বিচরণ করে, বন, জঙ্গল প্রভৃতি।বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত  ‘জঙ্গল’ শব্দের অর্থ বন, অরণ্য, ঝোপঝাড়পূর্ণ স্থান, নির্জনস্থান প্রভৃতি। অন্যদিকে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘বন’ শব্দের অর্থ অরণ্য, জঙ্গল, কানন, কুঞ্জ, গহন, বিপিন। আভিধানিক অর্থ বিবেচনায় অরণ্য, বন ও জঙ্গল – তিনটি শব্দই সমার্থক মনে হয়। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কোনো শব্দই সমার্থক হতে পারে না। কেননা, আর্থিক আর প্রায়োগিক পার্থক্যের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন থেকে সমার্থক শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। কোনো ব্যক্তি, বিষয় বা বস্তু অন্য কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা বিষয়ের মতো হওয়া মানে অভিন্ন হওয়া নয়। অভিধানে যেটি শব্দ, বাক্যে তা শব্দ থাকে না, পদ হয়ে যায়। শব্দার্থ একাধিক হতে পারে, কিন্তু পদার্থ বাক্যবিশেষে সুনির্দিষ্ট। যেমন : কেউ যদি প্রশ্ন করে, “ বলঅর্থ কী?” প্রশ্নের উত্তর হতে পারে শক্তি, খেলার বল, say প্রভৃতি। কিন্তু শব্দটি যখন বাক্যে বসে তখন তার অর্থ একদম সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। যেমন : বল শাহিন, শুধু বল দিয়ে কি বল খেলা যায়? প্রথম ‘বল’এর অর্থ say, দ্বিতীয় ‘বল’ এর অর্থ শক্তি এবং তৃতীয় বল এর অর্থ ফুটবল।

এবার বন-জঙ্গলে চলে যাই। অরমমান শব্দ থেকে অরণ্য শব্দের উৎপত্তি। প্রাচীন ভারতে অনেকে গুরুগৃহে শিক্ষাগ্রহণ সমাপ্ত করে বাড়ি ফিরতেন না। তাঁরা চিরকুমার-ব্রহ্মচারী হয়ে সংসার ও নারীসঙ্গ বর্জন করে অধ্যাত্মবিদ্যার অনুশীলন করতেন। অনেকে অধ্যাত্ম সাধনার জন্য বনে বসবাস করতেন। তাদের অরমমান বলা হতো। সাধারণ্যে, অরমমানগণ অরণ নামে পরিচিত ছিল। মূলত এ অরণ শব্দ থেকে অরণ্য শব্দের উৎপত্তি। অরণ হতে হলে এমন স্থানে বাস করতে হতো, যেটি ছিল খুবই দুর্গম এবং শ্বাপদসংকুল। ফলে সেখানে মনুষ্যবসত গড়ে তোলা অসম্ভব ছিল। সে অর্থে অরণ্য হচ্ছে ঘন গাছাপালায় গভীরভাবে ঢাকা বন্যপশুর অভয়াশ্রম যেখানে সংগত কারণে স্বাভাবিক মনুষ্যবসতি সম্ভব নয়। অরণ্যে মানুষজন থাকত না বলে সেখানে রোদন করলেও  করলেও সাহায্যের কেউ থাকে না। সব আবেদন নিষ্ফল হয়ে যেত। যা থেকে সৃষ্টি হয়েছে বাংলা বাগ্‌ধারা অরণ্যে রোদন, মানে নিষ্ফল আবেদন।

সুতরাং, কোনো স্থানকে অরণ্য হতে হলে ওই স্থানকে শুধু গাছপালায় আবৃত থাকলে হবে না, বন্য পশুর অবাদ বিচরণ থাকতে হবে এবং মনুষ্যবসতির অনুকূল পরিবেশও থাকতে পারবে না। যদিও বর্তমান বিশ্বে এমন স্থান ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। তাই অভিধানে এখন অরণ্যের সেই উৎপত্তিগত অর্থ কিছুটা বিস্তৃত হয়েছে। বন্য পশু বিচরণ করে গভীর জঙ্গল বা গভীর বনে। অতএব, উৎস-ঘটনা বিবেচনায় অর‌ণ্য শব্দের কার্যকর অর্থ হতে পারে ঘন গাছপালায় ঢাকা বন্যপ্রাণী অধ্যুষিত এবং মনুষ্যবাসের অনুপযুক্ত শ্বাপদসংকুল স্থান।

এবার বনে চলে আসা যাক। অরণ্য, বন ও জঙ্গল এ তিনটি শব্দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ ‘বন’। অভিধান ও প্রয়োগ উভয় ক্ষেত্রে রয়েছে তার অবাধ বিবচরণ। আলোচ্য তিন শব্দের মধ্যে কেবল বনেই ভোজন করা যায়, বেড়ানো হয়, আনন্দ করাযায়। বন নিয়েই রচিত হয়েছে আবেগঘন কবিতা, গান। শহরেও ঢুকে গেছে বোন : বনানী, বনশ্রী। সাহিত্যিকের নামও অলংকৃত করেছে বন : যেমন – বনফুল, বনবিহারী। বন নিয়ে গঠিত হয়েছে অনেক শব্দ। যেমন : বনকন্দ, বনকপোত, বনকর, নবকুক্কুট, বনচর, বনচাঁড়াল, বনচারী, বনজঙ্গল, বনজাত, বনতিক্ত, বনতুলসী, বনদেবতা, বনদেবী, বননিবাসিনী, বনপথ, বনপাল, বনফুল, বনবাদাড়, বনবাস, বনবিড়াল, বনবিহারী, বনভোজ, বনভোজন, বনমানুষ, বনমালী, বনমোরগ, বনরাজি, বনলক্ষ্মী, বনশ্রী, বসম্পদ, বনসাই, বনস্পতি প্রভৃতি। বন বলতে ফুলের বাগানও বোঝায়, যেমন : ফুলবন। হেমন্ত গেয়েছেন: “ সেদিনো বলেছিলে এই সে ফুলবনে – – -।” শচীন দেব বর্মণ গেয়েছেন, “নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা, নিশিতে যাইও ফুলবন। “ হেমন্ত-শচীনের বন আসলে অভিধানের জঙ্গল নয়। এটি অভিধানের কানন ও কুঞ্জ। অর্থাৎ বন হচ্ছে এমন একটি স্থান, যেটি অরণ্য নয়, আবার জঙ্গলও নয়।

জঙ্গল শব্দের অর্থ অভিধানে যাই থাকুক না কেন, বাক্য এবং কথায় শব্দটি সাধারণত ঝোপঝাড়পূর্ণ স্থান, নির্জনস্থান প্রভৃতি অর্থ প্রকাশে অধিক ব্যবহৃত হয়। বন বা অরণ্য যদি বাঘ হয়, তাহলে জঙ্গল হচ্ছে বিড়াল এবং বন হচ্ছে চিতাবাঘ। চিতাবাঘমুক্ত স্থান জঙ্গল। তাই অরণ্য বা বনকে জঙ্গল বললে এদের অপমান করা হয়, কিন্তু জঙ্গলকে বন বা অরণ্য বললে জঙ্গল পুলকিত হয়, যদিও তা সঠিক নয়। অর্থাৎ সকল জঙ্গল, অরণ্য বা বন নয়; তবে প্রত্যেক অরণ্য বা বনে কিছু না কিছু জঙ্গল থাকেই।

উপর্যুক্ত আলোচনা হতে বলা যায়, অরণ্য হচ্ছে মনুষ্যবাসের অনুপযুক্ত ও পশুপাখির নিরাপদ পরিবেশমণ্ডিত ঘন গাছপালা-বেষ্ঠিত স্থান। বন হচ্ছে এমন অরণ্য যেখানে অরণ্যপশুর সঙ্গে মানুষের বসতিও কিছুটা রয়েছে। আর জঙ্গল হচ্ছে ছোটো বন। অতএব দেখা যায়, অধুনা খুব কম অরণ্যই অভিধানে বর্ণিত বিশুদ্ধ অরণ্য-চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখতে পারছে। আমাজান অরণ্যের গভীরে যাই হোক, ইতস্তত রয়েছে মানুষের বাস, ফুলের বাগান। তাই আমাজানের মতো গভীর অর‌ণ্যকেও বলা হচ্ছে, আমাজান বন। অবশ্য ইংরেজিতে এসব কাহিনি খুব কম।তারা ফরেস্ট দিয়েই সব কাজ সেরে ফেলে।

 

Leave a Comment