চোখ মারা, পকেট মারা: গণপিটুনি এবং জামিন অযোগ্য অপরাধ

ড. মোহাম্মদ আমীন

চোখ মারা, পকেট মারা এবং গণপিটুনি

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত এবং জামিল চৌধুরী সম্পাদিক “বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান”-এ “চোখ মারা” শব্দের একটাই অর্থ এবং সেটি হচ্ছে, “এক চোখ বন্ধ করে অশালীন ইঙ্গিত করা”। তার মানে, ইঙ্গিত অন্ধকারে করলেও এমনকি নিজে নিজে করলেও অশালীন হয়ে যাবে। আমি আমার মেয়েকে শিশুকালে ‘চোখ মারা’ দিয়ে আদর দিতাম, কাছে ডাকতাম; রাস্তায় কখনও কখনও শিশু দেখলে ওই লক্ষে ‘চোখ মারা’ দিতাম; এখন দিই নাতি-নাতনিদের। জামিল চৌধুরীর অভিধান মতে, এসব অশালীন। তাহলে“চোখ মারা” কি বন্ধ করে দিতে হবে? তা যদি হয় তো চোখ রেখে লাভ কী? 

 অন্যের অলক্ষে কাউকে কিছু ইঙ্গিত করার জন্য ‘চোখ মারা’ বহুল প্রচলিত একটা মধুর, শালীন এবং ধ্রুপদী বিষয়। এমন করেননি এমন কেউ নেই। জামিল চৌধুরী নিজেও করেছেন, এখন বুড়ো বয়সে এসে এগুলোকেও অশালীন করে দিলেন! এজন্য অনেক ভাষাবিদ ও বৈয়াকরণের কাছে “বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান” একটি “অবিধান”।পৃথিবীতে এমন কোনো খ্যাত লোক নেই, যারা চোখ মারেননি, কিন্তু এজন্য তাদের অশালীনত্বে পড়তে হয়ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওমাবা আর জর্জ বুশের চোখ মারা তো ভূবনজয়ী। কই তাদের কি এজন্য অশালীন অপবাদ পেতে হয়েছে? তার মানে, “ চোখ মারা”কে কেবল অশালীনত্ব দিয়ে প্রকাশ করা সমীচীন হয়নি।

পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় ‘চোখ মারা’ কথার অনেকগুলো অর্থ; যেমন : বাঁকা চাউনি, কটাক্ষ করা, কামাতুর বা লালসাপূর্ণ চাহনি, শিশুদের প্রতি আদুরে ইঙ্গিত, অন্যের অলক্ষে কাউকে কিছু ইঙ্গিত করা, ইশারা হানা, শিশুদের সঙ্গে আনন্দ করা, প্রেমময়তা,অনুভূতির মুগ্ধ প্রকাশ, বিহ্বল হয়ে পড়ার ইঙ্গিত, প্রেমের আহ্বান ইত্যাদি ছাড়াও আরও অনেক বিষয় যুক্ত দেখা যায়। বাংলায় কেন ‘চোখ মারা’ কথাটাকে কেবল অশালীন ইঙ্গিতে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তা জানি না। বাঙালিরা বুঝি ক্রমশ বুড়ো, অথর্ব, নপুংসক, একরোখা এবং বৈচিত্র্যহীন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দশ-পনের বছর আগেও “চোখ মারা” ছিল অনেক মজার কাণ্ডকারখানায় ভরপুর একটি বহুমুখী প্রৈমিক বিষয়। “চোখ মারা” না-থাকলে তো চলচ্চিত্রই হতো না, চোখেরই বা কী প্রয়োজন? জামিল চৌধুরীর অর্থ অনুযায়ী আকাশ লক্ষ করে “চোখ মারা”ও অশালীন, কোথায় যাবেন এখন? চোখ খুলে ঘরে রেখে যান।

একসময় “পকেট মারা” অপরাধ ছিল, সাধারণত “চোখ মারা” নয়। ‘চোখ মারা’ দিয়েই শুরু হতো প্রেম। এখন অবশ্য প্রেমের সুচনার জন্য ‘চোখ মারা’র প্রয়োজন পড়ে না, সোজা ‘শরীর মারা’ দিয়ে শুরু করার ইচ্ছা ও সুযোগ প্রবল। তাই “চোখ মারা” এখন অপরাধ; নীতিমতো- পকেট মারার চেয়ে জঘন্য। অবশ্য মেয়েদের

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

“চোখ মারা” অপরাধ নয়, কেবল মেয়েদেরকেই “চোখ মারা” অপরাধ। “চোখ মারা” নিয়ে কত কবিতা হয়েছে, গান হয়েছে, সিনেমা হয়েছে, কিন্তু কোনো মামলা হয়নি। এখন “চোখ মারা” নিয়ে মামলাও হয় বিস্তর, অহরহ।

চিরন্তন বাংলা সিনেমায় “চোখ মারা” একসময় অশীতিপর বুড়োবুড়িকেও জাগিয়ে তুলত, কিছুক্ষণের জন্য হলেও। এখন মানুষ সভ্য হচ্ছে, যত সভ্য হচ্ছে তত বেশি চোখ ফুটছে। যত বেশি চোখ ফুটছে ‘‘চোখ মারা’’ তত ভয়ঙ্কর অপরাধে পরিণত হচ্ছে। এখন হাওয়ায় “চোখ মারা” নয়, সোজা লক্ষ শরীর। তাই ‘চোখ মারা’ এখন পকেট মারা, বারি মারা, লাথি মারা, হাতি মারা, গুলি মারা, ধাক্কা মারা , এমনকি কখনও কখনও মানুষ মারার চেয়েও মারাত্মক। যদি কাজটি মেয়েদের, বিশেষ করে যুবতী, আরও বিশেষ করে সুন্দরী যুবতী, আরও বিশেষ-বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত ধনেমানে শ্রেষ্ঠ যুবতী-সুন্দরী মেয়েদের লক্ষ করে বর্ষিত হয়।

সাবধান, আগে যতই চোখ মারুন না কেন, এখন কিন্তু ভুলেও চোখ মারবেন না। প্রয়োজন হলে, চোখ দুটো অন্ধ করে দিন, নিজেকে মেরে ফেলুন। চোখ মারালে যে-কোনো মুহূর্তে নারী নির্যাতন হয়ে যেতে পারে, মামলা হয়ে গেলে নব্বই দিনের আগে জামিন নেই। অতএব, আপনিই যাই মারুন, মেয়েদেরকে “চোখ মারা” থেকে বিরত থাকুন। মেয়েরা আপনাকে যতই “চোখ মারা” দিক না কেন। কী অভাগ্য আমাদের ভাগ্য! আমরা আমাদের আচরণ দিয়ে ‘চোখ মারা’র মতো রোমান্টিক একটা বিষয়কে জামিন-অযোগ্য অপরাধ বানিয়ে ফেলেছি।

ড্রাইভিং, ড্রাইভিং-লাইসেন্স: ড্রাইভিং-লাইসেন্স সনদ নয় কেন

#subach

Leave a Comment

চার: চার সংখ্যার জাদু, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে চার সংখ্যার প্রভাব

ড. মোহাম্মদ আমীন

চার: চার সংখ্যার জাদু, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে চার সংখ্যার প্রভাব

গণিতে চার (৪) অঙ্কটি বেশ মজার। এটিই প্রথম স্বপরিচিত ক্ষুদ্রতম বর্গ সংখ্যা। ৪-এর অর্ধাংশ ২ হচ্ছে ৪-এর বর্গমূল। ৪ নামের অঙ্কটির অর্ধেককে যোগ করলে যা হয়, গুণ করলেও তা হয়, এমনকি বর্গ করলেও। অন্য অঙ্ক বা সংখ্যার সঙ্গে মেশার গুণ তার প্রবল। এজন্য চারকে মিশুকে অঙ্ক বলা হয়। ভূগোলে চার-এর প্রভাব সীমাহীন। কেবল চারটা দিক দিয়ে বিশ্বের পূর্ণ বিস্তৃতি ও পরিচয় নির্দেশ করা যায়। বাংলা ভাষাতেও চার মিশুকে শব্দ হিসেবে পরিচত। ‘চার’ শব্দটি বাংলায় চৌ হয়ে কত আর্য-অনার্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে কত শব্দ-সন্তানের যে জন্ম দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

সংস্কৃত ‘চতুর্‌’ শব্দ থেকে উদ্ভূত চৌ সাধারণভাবে বিশেষণ। এর অর্থ চার। কিন্তু বাংলায় ‘চৌ’ শব্দটির স্বাধীন ব্যবহার নেই। এটি অন্য শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চার-প্রাধান্যজ্ঞাপক নানা জাতের বৈচিত্র্যময় শব্দ গঠন করে। বৈয়াকরণগণ ‘বৌ’ শব্দের ঘোমটা খুলে ‘বউ’ করে দিতে সক্ষম হলেও ‘চৌ’ শব্দের ঘোমটায় হাত দেওয়ার সাহস পাননি। যদিও আধুনিক ‘বৌ’ ঘোমটা পরে না বলে, ‘বউ’ বানানই সংগত। ‘চৌ’ অন্য শব্দের সঙ্গে বসে কীভাবে এবং কত রকমের  বিশেষ্য, বিশেষণ এবং ক্রিয়াবিশেষণ গঠন করে তা দেখা যাক :

  1. চৌকশ: হিন্দি ‘চৌকশ’ শব্দের অর্থ – বিশেষণে চারদিকে দৃষ্টি আছে এমন, চতুর, সব বিষয়ে অভিজ্ঞ।
  2. চৌকা: সংস্কৃত চতুষ্ক হতে আগত চৌকা শব্দের অর্থ : বিশেষণে চার কোণবিশিষ্ট, বিশেষ্যে চার ফোটাযুক্ত তাস, উনুন, চুলা প্রভৃতি।
  3. চৌকাঠ: বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা চৌকাঠ শব্দের অর্থ চৌবাহুবিশিষ্ট যে কাঠামোর সঙ্গে দরজা লাগানো হয়। সাধারণত এই কাঠামোটি কাঠের হয়ে থাকে। তাই শব্দটি চৌকাঠ।
  4. চৌকি: সংস্কৃত চতুষ্কী থেকে উদ্ভূত ও বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত ‘চৌকি’ শব্দের অর্থ চারটি পায়াযুক্ত খাট, তক্তপোশ; প্রহরী, ফাঁড়ি, কর আদায়ের ঘাঁটি। চৌকি হতে ‘চৌকিদার। বাংলা চৌকি ও ফারসি দার মিলিতি হয়ে চৌকিদার। এর অর্থ চারদিক যে পাহারা দেয়, প্রহরী, কর আদায়কারী প্রভৃতি।
  5. চৌকুনে, চৌকো চৌকোণা : বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত এই শব্দগুলোর অর্থ চারটি কোণ আছে এমন, চারকোণবিশিষ্ট, চতুষ্কোণ।
  6. চৌখণ্ড: বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা চৌখণ্ড শব্দের অর্থ চারভাগে বিভক্ত, চারটি চালবিশিষ্ট। চৌখণ্ড থেকে চৌখণ্ডিয়া। চৌখণ্ডিয়া শব্দের অর্থ বিশেষণে চার পায়াযুক্ত, বিশেষ্যে চারটি পায়াযুক্ত পিঁড়ি।
  7. চৌখুপি: শব্দটি বাংলা। এর অর্খ বিশেষণে চারটি খোপবিশিষ্ট, চেককাটা এবং বিশেষ্যে চৌকো ছককাটা নকশা।
  8. চৌখুরি: শব্দটি বাংলা এবং অর্থ বিশেষ্যে চারটি খুর বা পায়াযুক্ত কাঠের আসন, চৌকি।
  9. চৌগুণ, চৌগুনা, চৌগুনো : তিনটি শব্দই বাংলা এবং বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শব্দগুলো সমার্খক এবং অর্থ হচ্ছে : চারগুণ, চর্তুগুণ। যেমন : তিন এর চারগুণ বারো।
  10. চৌগপ্পোঁ: বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা চৌগপ্পোঁ শব্দের অর্থ চেয়ালের দাড়ি দুদিকে ভাগ করে গোঁফের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে এমন। এরূপ দাড়ি দেখতে চার এর মত লাগে।
  11. চৌঘাট: বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা ‘চৌঘাট’ শব্দের অর্থ চার দিকের ঘাট; চারঘাট, চতুর্দিক।
  12. চৌঘুড়ি: বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা ‘চৌঘুড়ি’ শব্দের অর্থ চার ঘোড়ায় টানা গাড়ি।
  13. চৌচাকা, চৌচাক্কা : সংস্কৃত চতুশ্চক্র হতে উদ্ভূতি ‘চৌচাকা’ ও ‘চৌচাক্কা’ শব্দের অর্থ বিশেষণে চারটি চাকাবিশিষ্ট।
  14. চৌচাপট, চৌচাপড় : বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা ‘চৌচাপট’ ও ‘চৌচাপড়’ শব্দের অর্থ চতুর্দিকের স্থান, চতুর্দিকের বিস্তার, সমচতুর্ভুজ প্রভৃতি।
  15. চৌচাপটে: বাংলা ‘চৌচাপটে শব্দের অর্থ ক্রিয়াবিশেষণে চারদিকে, যথাযথভাবে, সর্বতোভাবে এবং বিশেষণে পূর্ণমাত্রায়।
  16. চৌচালা: বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা ‘চৌচালা শব্দের অর্থ চারটি চালবিশিষ্ট।
  17. চৌচির: চৌচির বাংলা শব্দ। এর অর্থ বিশেষণে চারটি খণ্ডে বিভক্ত, খণ্ডবিখণ্ড।
  18. চৌঠা: সংস্কৃত তুতর্থ থেকে উদ্ভূত বাক্যে বিশেষ্য ও বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত ‘চৌঠা’ শব্দের অর্থ মাসের চতুর্থ দিন, মাসের চার তারিখ (চৌঠা বৈশাখ)।
  19. চৌতলা: বাংলা ‘চৌতলা’ শব্দের অর্থ বিশেষ্যে চতুর্থ তলা এবং বিশেষণে চারটি তলবিশিষ্ট।
  20. চৌতারা: সংস্কৃত চত্বর থেকে উদ্ভূত বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত ‘চৌতারা’ শব্দের অর্থ চত্বর, অঙ্গন, উঠান। বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত ফারসি ‘চৌতারা’ শব্দের অর্থ মেঝের ‍ওপর খাড়া করে রেখে চেয়ারে বসে টোকা দিয়ে বাজানো হয় এমন বেহালাসদৃশ বৃহদাকার তারযন্ত্র।
  21. চৌথ: সংস্কৃত ‘চতুর্ ‘ থেকে উদ্ভূত ও বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত ‘চৌথ’ শব্দের অর্থ এক চতুর্থাংশ, চারভাগের একভাগ, প্রজার উপস্বত্বের চতুর্থ ভাগ; মারাঠা শাসক কর্তৃক আদায়কৃত পরাজিত রাজা বা কৃষকের উৎপাদিত ফসলের এক চতুর্থাংশ বা তার সমপরিমাণ মূল্য।
  22. চৌদিক, চৌদিশ : সংস্কৃত ‘চতুর্দিক থেকে উদ্ভূত ‘চৌদিক’ এবং সংস্কৃত ‘চতুর্দিশ’ শব্দ থেকে উদ্ভূত ‘চতুর্দিশ’ শব্দের অর্থ যথাক্রমে সবদিক ও চারটি দিক। এটি বিশেষ্য।
  23. চৌদুলি: বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা ‘চৌদুলি শব্দের অর্থ চর্তুদোলা বহন করার বৃত্তি, চতুর্দোলা বহনকারী জাতিবিশেষ।
  24. চৌদোল : বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘চর্তুদোল’ শব্দ থেকে আগত ‘চৌদোল’ শব্দের অর্থ সামনে দুজন এবং পিছনে দুজন মোট চারজনের কাঁধে বহন করা হয় এমন ডুলি, পালকি, শিবিকা।
  25. চৌদোলা: সংস্কৃত ‘চতুর্দল’ শব্দ থেকে উদ্ভূত ও বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত ‘চৌদোলা শব্দের অর্থ চারজনে কাঁধে বহন করা হয় এমন ডুলি, পালকি, শিবিকা।
  26. চৌধুরি: বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হিন্দি ‘চৌধুরি’ শব্দের অর্থ নৌ, হস্তী, অশ্ব ও পদাতিরূপ চার শক্তির অধিকারী সামন্ত রাজা, গ্রামের মোড়ল, পদবিবিশেষ।
  27. চৌপথ: বাংলা ‘চৌ’ ও সংস্কৃত ‘পথ’ শব্দের মিলনে ‍সৃষ্ট ‘চৌপথ’ শব্দের অর্থ বিশেষ্যে চারটি পথের সংযোগস্থল, চৌরাস্তা, চৌমাথা।
  28. চৌপদ: সংস্কৃত ‘চতুষ্পদ’ থেকে উদ্ভূত ও বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত ‘চৌপদ’ শব্দের অর্থ চার পা-বিশিষ্ট, চতুষ্পদ। চৌপদ থেকে চৌপদী।
  29. চৌপদী: সংস্কৃত ‘চতুষ্পদী’ থেকে উদ্ভূত ও বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত ‘চৌপদী’ শব্দের অর্থ বিশেষ্যে চার চরণবিশিষ্ট ছন্দ এবং বিশেষেণ চার পা-বিশিষ্ট, চতুষ্পদ
  30. চৌপর, চৌপহর, চৌপ্রহর: সংস্কৃত চতুঃপ্রহর থেকে উদ্ভূত ‘চৌপর’, ‘চৌপহর’ ও ‘চৌপ্রহর’ শব্দের অর্থ বিশেষ্যে চার প্রহরকাল, ক্রিয়াবিশেষণে সর্বদা, সর্বক্ষণ, দিনরাতব্যাপী।
  31. চৌপল: বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হিন্দি ‘চৌপল’ শব্দের অর্থথ চারটি কোণবিশিষ্ট।
  32. চৌপাটি, চৌপাঠি, চৌপাড়, চৌপাড়ি, চৌবাড়ি : সংস্কৃত ‘চতুষ্পঠী’ হতে উদ্ভূত ও বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত শব্দগুলোর অর্থথ চতুর্বেদ বা চার-বেদ অধ্যয়নের স্থান, টোল, যে পাঠশালায় সংস্কৃত পড়ানো হয়।
  33. চৌপায়া: সংস্কৃত ‘চতুষ্পদী’ থেকে উদ্ভূত ‘চৌপায়া’ শব্দের অর্থ বিশেষণে চারটি পায়াবিশিষ্ট; বিশেষ্যে চৌকি, খাট।
  34. চৌপাশ: সংস্কৃত ‘চতুপার্শ্ব’ থেকে উদ্ভূত এবং বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত এ শব্দের অর্থ চারদিক।
  35. চৌবাচ্চা: বাক্যে বিশেষ্য হিসেব ব্যবহৃত ফারসি চৌবাচ্চা শব্দের অর্থ চারকোণবিশিষ্ট জলাধারা।
  36. চৌবে: সংস্কৃত ‘চতুর্বেদ ‘ থেকে উদ্ভূত ‘চৌবে’ শব্দের অর্থ বিশেষণে চারটি বেদে অভিজ্ঞ এমন, চৌবেদি এবং বিশেষ্যে পদবিশেষ।
  37. চৌমহলা: বাংলা ‘চৌমহলা’ শব্দের অর্থ বিশেষণে চারটি মহলে বিভক্ত এমন এবং বিশেষ্যে চারমহলা বাড়ি।
  38. চৌমোহনা: বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত, বাংলা ‘চৌমোহনা শব্দের অর্থ চারটি নদীর সংগমস্থল।
  39. চৌযুগ: সংস্কৃত ‘চতুর্যুগ’ থেকে উদ্ভূত ‘চৌযুগ’ শব্দের অর্থ বিশেষ্যে পুরাণে কল্পিত চারটি যুগ(সত্য ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি) এবং ক্রিয়াবিশেষণে চিরকাল, সর্বকাল।
  40. চৌয়ারি : হিন্দি চৌয়ারি শব্দের অর্থ বিশেষ্যে চার চালবিশিষ্ট ঘর, চারদুয়ারি ঘর এবং বিশেষেণে চৌচালা।
  41. চৌরাস্তা: বাংলা ‘চৌ’ এবং ফারসি ‘রাস্তা’ শব্দের মিলনে সৃষ্ট এবং বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত ‘চৌরাস্তা’ শব্দের অর্থ চারটি রাস্তার সংযোগস্থল, চৌমথা।
  42. চৌরস: সংস্কৃত চতুরশ্র থেকে উদ্ভূত ও বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত ‘চৌরস’ শব্দের অর্থ চারকোনা, চওড়া, প্রশস্ত, সমান, মসৃণ প্রভৃতি।
  43. চৌরি: বাংলা চৌরি শব্দের অর্থ বিশেষ্যে চৌচালা ঘর এবং বিশেষণে চৌচালা।
  44. চৌশাল: সংস্কৃত চতুঃশাল হতে আগত চৌশাল শব্দের অর্থ বিশেষ্যে চতুষ্কোণ উঠান ঘরে নির্মিত অট্টালিকাশ্রেণি এবং বিশেষণে চক-মিলানো।
  45. চৌশিঙা: বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা চৌশিঙা শব্দের অর্থ বিশেষণে চারটি শিং আছে এমন এবং বিশেষ্যে চার শিং বিশিষ্ট হরিণ।
  46. চৌহদ্দি: বাংলাে ‘চৌ’ ও ফারসি ‘হদ্দ’ শব্দের মিলনে গঠিত ও বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত ‘চৌহদ্দি’ শব্দের অর্থ চারদিকের সীমানা, চতুঃসীমা, চার সীমা।

ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল

#subach

Leave a Comment

বেশি ও বেশী: কখন কোনটি

ড. মোহাম্মদ আমীন

বেশি ও বেশী: কখন কোনটি

 ‘বেশি’ ও ‘বেশী’ ভিন্নার্থক শব্দ। বাংলায় উচ্চারণগত দীর্ঘস্বর নেই। তাই দীর্ঘস্বরের জন্য উচ্চারণের কোনো পরিবর্তন হয় না। এজন্য বানান ভিন্ন হলেও ‘বেশি’ ও

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

‘বেশী’ উভয় শব্দের  উচ্চারণ অভিন্ন। তবে উচ্চারণ অভিন্ন হলেও উভয় শব্দের অর্থ ভিন্ন। অনেকে শব্দদুটোর বানান গুলিয়ে ফেলেন।

বেশি ফারসি শব্দ। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত ফারসি বেশি শব্দের অর্থ অধিক এবং বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত বেশিশব্দের অর্থ প্রাচুর্য। জগজিৎ সিং গেয়েছেন :  বেশি কিছু আশা করা ভুল, বুঝলাম আমি এতদিনে—।  আরো কয়েকটি প্রয়োগ দেখুন : 

তরকারিতে লবণ বেশি হলে কী করবেন? 
বেশি দিন আগের কথা নয়।
বেশি কথা বলা ভালো নয়। 

অন্যদিকে, বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত “ – বেশী” শব্দের অর্থ বেশধারী। তবে বাংলায় ‘‘-বেশী’’ শব্দটি স্বাধীনভাবে ব্যবহৃত হয় না। অন্য শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্যবহৃত হয়। যেমন:

ভদ্রবেশী লোকটাকে চিনতে পারলে এমন ক্ষতি হতো না।
বেশি লোকই ছদ্মবেশী।

উৎস: ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

বিদ্যুদায়ন বিদ্যুতায়ন; বৈদ্যুতিক; বিদ্যুদায়িত বিদ্যুতায়িত

স্ত্রীবাচক শব্দে পুরুষাধিপত্য

ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল

প্রেসক্রিপশনে RX কেন লেখা হয়

#subach

Leave a Comment

প্রেসক্রিপশনে RX কেন লেখা হয়

. মোহাম্মদ আমীন

প্রেসক্রিপশনে RX কেন লেখা হয়

প্রেসক্রিপশন বা চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্রের সূচনায় চিকিৎসকগণ সাধারণ ‘Rx’  লিখে থাকেন। কেন এটি লেখা হয় এ নিয়ে কয়েকটি মতবাদ প্রচলিত আছে। কয়েকটি মতবাদ নিচে দেওয়া হলো।

প্রথম মতবাদটি জুপিটার বা বৃহস্পতি মতবাদ নামে পরিচিত। এই মতবাদিগণের মতে, Rx হচ্ছে বৃহস্পতি বা জুপিটার (jupitar) গ্রহের

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

জ্যোর্তিবৈদ্যিক(Astrological) চিহ্ন।এই গ্রহটি রোমান দেবতাদের রাজা এবং সবচেয়ে ক্ষমতাবান। তাই প্রেসক্রিপশনে ওষুধের নাম লেখার পূর্বে Rx চিহ্নটি লেখা হয়। যাতে প্রেসক্রিপশনে বিবৃত পথ্যের ওপর তথা রোগীর উপশমে দেবরাজ জুপিটার শুভদৃষ্টি দেন। কথিত হয়, Rx চিহ্ন থাকলে ওই প্রেসক্রিপশন অতি কার্যকর হয়।

দ্বিতীয় মতবাদ, অনেকে বলেন, প্রাচীন একটি ল্যাটিন শব্দ থেকে RX প্রতীকটি এসেছে। এই শব্দটি হলো Recipe, যার অর্থ, ‘আপনি নিন বা আপনি গ্রহণ করুন’। প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যে ‘উটচাট’ বা ‘হোরাসের চোখ’ নামে এক ধরনের কবচের প্রচলন ছিল। হোরাস ছিলেন স্বাস্থ্য দেবতা। ‘হোরাসের চোখ’ নামে যে কবচ প্রচলিত ছিল তা অনেক রোগ প্রতিরোধ করত বলে বিশ্বাস করা হতো। এ কবচের প্রাথমিক আকৃতি অনেকটা হেরাসের চোখের মতো ছিল। তবে এটা নানান জিনিস দিয়ে তৈরি করা হতো। এভাবে এটি ব্যবহৃত হতে শুরু করে এবং কালক্রমে ব্যবস্থাপত্রে চলে আসে। তবে চিহ্নটি ব্যবস্থাপত্রে ব্যবহৃত হওয়ার পেছনে দেবতার অনুগ্রহের ওপর বিশ্বা্সই যে অন্যতম নিয়ামক ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

তৃতীয় মতবাদকে জেসাস মতবাদ বলা হয়। এই মতানুসারে, Rx = R = Refer to এবং X = Jesus Christ, অর্থাৎ Rx = Refer to Jesus Christ। এর অর্খ হলো‘ জিশুর (যিশুর) নামে পড়া শুরু করুন’ বা জিশুর নামে গ্রহণ করা শরু করুন বা জিসুর নামে শুরু করুন। ‘X’ দ্বারা জেসাস ক্রাইস্ট বা জিশু খ্রিস্টকে বোঝানো হয়। যেমন Xmas দ্বারা বোঝানো হয় ক্রিসমাস। উল্লেখ্য, X দিয়ে গ্রিক অক্ষর ‘Chi’ কে নির্দেশ করে। এর দ্বারা মূলত গ্রিক ভাষায় সংক্ষেপে ক্রাইস্ট বা যিশুকে বোঝানো হয়ে থাকে।

চতুর্থ মতবাদটি যৌক্তিকার্থ মতবাদ নামে পরিচিত। চিকিৎসাশাস্ত্রের অভিধান মতে, Rx ল্যটিন শব্দ যার অর্থ উপায়, কৌশল, পদ্ধতি এবং লওয়া বা গ্রহণ করা (recipe ও to take) প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়।

এ বিষয়ে আর একটি মতবাদ আছে। এটাকে অনেকে আধুনিক মতবাদ বল থাকেন। তাদের মতে, Rx মানে Report extended। শরীরের রোগ নির্ণয়পূর্বক এমন একটি ‘এক্সটেন্ডেড’ প্রতিবেদন করা হয় যেখানে পরবর্তী পদক্ষেপ বর্ণিত থাকে। এজন্য প্রেসক্রিপশনে ওষুধের নাম লেখার সূচনায় Report extended-এর পরিবর্তে সংক্ষেপে Rx লেখা হয়

বিদ্যুদায়ন বিদ্যুতায়ন; বৈদ্যুতিক; বিদ্যুদায়িত বিদ্যুতায়িত

স্ত্রীবাচক শব্দে পুরুষাধিপত্য

প্রেসক্রিপশনে Rx লেখা হয় কেন; শুবাচ?

#subach

Leave a Comment

স্ত্রীবাচক শব্দে পুরুষাধিপত্য

. মোহাম্মদ আমীন

স্ত্রীবাচক শব্দে পুরুষাধিপত্য

বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত তৎসম ‘আত্মোপজীবী’ শব্দের ব্যুৎপত্তি (আত্মন্‌+উপ+√জীব্‌+ইন)। এর অর্থ দৈহিক পরিশ্রম দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে এমন। অন্যদিকে, বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত তৎসম ‘আত্মোপজীবিনী’ শব্দের ব্যুৎপত্তি হচ্ছে (আত্মন্‌+উপ+√জীব্‌+ইন+ঈ)। শব্দটির অর্থ যৌনকর্মী। অভিন্ন ব্যুৎপত্তি, অভিন্ন গঠন, অভিন্ন বৈশিষ্ট্য। তারপরও শুধু স্ত্রীবাচক করে দিয়ে তৎকালীন বৈয়াকরণবৃন্দ একটি শব্দের অর্থকে নির্মম নীচতায় কদর্থে পরিণত করে দিয়েছে। আত্মোপজীবী শব্দটি লিঙ্গ পরিবর্তন করায় তাকে কামনার ঘৃণ্য লালসায় মুড়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের আত্মকর্মকে কী হেয়ভাবে দেখা হতো শব্দটি তার একটি দৃষ্টান্ত। এরকম আরো অনেক শব্দ আছে। শব্দে পুরুষের এরূপ একপেশে আধিপত্য তাদের মানসিক দীনতার পরিচয় বহন করে।

পুরুষ-লিখিত শাস্ত্রমতে, ‘পুৎ’ নামক নরক থেকে উদ্ধার করে বলে ছেলে সন্তানকে পুত্র বলা হয়। এবার দেখা যাক, কন্যার ব্যুৎপত্তি কী? সে কাউকেই ত্রাণ বা

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

উদ্ধার করতে পারে না, বরং তার কাছ থেকে জন্মদাতা ত্রাণ চায়। আত্মোপজীবিনীর মতো কন্যা শব্দটিকেও কামনার রেশ দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মহাভারতে ব্যাসদেবের ব্যাখ্যা দেখলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে: সর্বান্ কাময়তে যস্মাৎ (৩.৩০৬.১৩)। এর অর্থ ‘কন্যা মানে ‘কাম্যা’। কন্ আর কম্ কুটুম্ব ধাতু। এখানে দেখা যায় কামনা।

‘ভগিনী’ শব্দটির অর্থ ভগাযুক্ত, অনেকে সরাসরি স্ত্রীচিহ্ন-ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করেন। আলংকারিক কবি দণ্ডী ‘ভগিনী’ শব্দকে জুগুপ্সাব্যাঞ্জক বলে অবিহিত করেছেন। তিনি সাহিত্যে শব্দটির ব্যবহার থেকে বিরত থাকার পরামর্শ বিধৃত করে বলেছেন – ভগিনী-ভগবত্যাদি গ্রাম্যকক্ষাং বিগাহতে। পুরুষের সমকক্ষ হয়েও কন্যা কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদের দাবিদার হবে তা ছিল কল্পনারও বাইরে। এ জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ, প্রেসিডেন্ট, চেয়ারম্যান, মন্ত্রী ইত্যাদি শব্দের স্ত্রীলিঙ্গের কথা ভাবাই হয়নি।

এবার স্ত্রী শব্দে চলে আসা যাক। ‘স্ত্রী’ শব্দে গর্ভধারণের বিষয়টাই ছিল মুখ্য। ‘স্তৈ’ ধাতুর মূলে, স্ত্যায়তে শুক্র শোণিতে য়ম্যাস্, যার অর্থ ‘শুক্রশোণিত যেখানে বা যাতে কাঠিন্য পায়’। স্ত্রীর একটি বহুল প্রচলিত প্রতিশব্দ ভার্যা। ‘ভার্যা’ নামটাই অবমাননাকর। বলা হয়েছে, “পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা”। অর্থাৎ স্ত্রী, পুত্র উৎপাদনের যন্ত্র। স্ত্ররি মতো অর্ধাঙ্গিনীর উপর যৌনতা আরোপিত হওয়ায় ‘ভার্যা’ যখন পুত্র উৎপাদনের যন্ত্র হয়ে দাঁড়ায় তখন ভার্যার সন্তানদের মনে কি কষ্ট জাগে না? কত জঘন্য ছিল তৎকালীন সমাজপতি এবং শিক্ষিত জনরা।

অঙ্গনা, রমণী, কামিনী, ললনা, প্রমদা, যোযা, যোযিৎ, বনিতা এরূপ অসংখ্য নামেই নারীদের ডাকা হয়। কিন্তু কোনটায় ‘নারী’ হিসেবে নারীকে সম্মান এবং মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়নি। এটি নারীদের প্রতি প্রাচীন পুরুষ-শাসিত সমাজের নির্লজ্জ জুলুম ও চরম আধিপত্যবাদী মনোবৃত্তির পরিচায়ক। এখনও অনেকের মধ্যে এরূপ ঘৃণ্য আচরণ লক্ষণীয়।

‘অঙ্গনা’ শব্দে অঙ্গসৌষ্ঠবের আকর্ষণ লোলুপতাকে প্রকট করে তোলা হয়েছে। ‘রমণী’ শব্দটি যে রমণের ঈঙ্গিতবাহী তা সবার জানা। এ প্রসঙ্গে কবিকঙ্কণের একটি লাইন প্রাসঙ্গিক মনে হলো। তিনি বলেছেন, ‘রমণে রমণী মরে কোথাও না শুনি।’ ‘কামিনী’ শব্দ কম্ -ধাতুজ্। এর কামনারই ধন। শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে অত্যন্ত কামুকী হিসেবে। কাশীরাম লিখেছেন, ‘কামিনী দেখিয়া কামে হইল বিভোর।’ ‘ললনা’ মানে বিলাসিনী। পুরুষকে যে নানাভাবে ছলাকলায় (লালয়িত পুমাংসম) লুব্ধ করে তাদের বলা হয়েছে ললনা। নারীর আর একটি প্রতিশব্দ ‘প্রমদা’। এই শব্দের ব্যাখ্যা বলা হয়েছে মাদকতার কথা। মাদক যেমন মত্ত করে দেয়, তেমনি প্রমাদারাও মত্ত করে দেয়। ‘যোযা’ ও যোযিৎ’ ললনার অর্থবাহী অর্থাৎ বিলাসিনী, পুরুষকে যে প্রলুব্ধ করে প্রভৃতি।

যে পুরুষ, স্ত্রীর একান্ত অনুগত, বউকে ভয় করে, শ্রদ্ধা বা সমীহ করে তাকে বলা হয় স্ত্রৈণ। শব্দটা সবসময় নেতিবাচক এবং নিকৃষ্টতা প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কোনো পুরুষ, স্ত্রীর অনুগত হলে সে আর পুরুষ আর উৎকৃষ্ট থাকে না; কাপুরুষের চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে যায়। অতএব উৎকৃষ্ট পুরুষ কখনো স্ত্রৈণ হতে পারে না। সুতরাং উৎকৃষ্ট পুরুষ হতে হলে তাকে সবসময় তার স্ত্রীর অবাধ্য হতে হবে। যে নারী, স্বামীর একান্ত অনুগত এবং স্বামীকে ভয় করে, শ্রদ্ধা বা সমীহ করে করে তাকে বলা হয় পতিব্রতা। শব্দটি ইতিবাচক এবং উৎকৃষ্ট নারী প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ যে নারী স্বামীর একান্ত অনুগত সে উৎকৃষ্ট নারী এবং যে নারী স্বামীর অনুগত নয়, সে নারী নিকৃষ্ট নারী। অতএব অভিধানমতে, কোনো নারীকে উৎকৃষ্ট হতে হলে তাকে পতিব্রতা হতে হবে।তার স্বামীর সর্বাদেশ বিনাবাক্যে মেনে চলতে হবে।

স্ত্রৈণ যদি নেতিবাচক হয় তাহলে পতিব্রতা শব্দও নেতিবাচক হওয়াই ছিল সমীচীন। কিন্তু হয়নি, কারণ কর্তারাই এই কর্মটি করেছে। বস্তুত প্রাত্যহিক জীবনে নারীর ওপর নিজেদের আধিপত্য সৃষ্টির জন্য ধূর্ত পুরুষকর্তারা হীনম্মন্যতার সঙ্গে এমন নিকৃষ্ট-উৎকৃষ্ট অনেক অনেক শব্দ সৃষ্টি করে গেছেন। এই আলোচনা হতে বোঝা যায়, স্ত্রৈণ শব্দের লিঙ্গাত্বক বিপরীত শব্দ ‘পতিব্রতা’। প্রসঙ্গত, ‘স্ত্রীবশ্য’ এবং ‘স্বীয়া’ স্ত্রৈণ শব্দের দুটি সমার্থক শব্দ।

শুধু সংস্কৃত ভাষায় নয়, ইংরেজি ও ল্যাটিন ভাষাতেও নারীদের প্রতি এমন ন্যাক্কারজনক আচরণ করা হয়েছে। ল্যাটিন sator শব্দের সঙ্গে স্ত্রীর উচ্চারণ-সাম্য লক্ষণীয়। ল্যাটিন শব্দটির অর্থ begetter । অন্যদিকে, স্ত্রীবাচক ‘দার’ শব্দটির মূল অর্থ কৃষ্টভূমি। কর্ষণের জন্য নির্ধারিত ভূমি। নারীকে বলা হয়েছে ভূমিকল্পা, বীজ-বপনে সন্তান-শস্য উৎপাদিকা।

ইংরেজিতে , woman, mistress, madam প্রভৃতি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত ইতিহাস নারী-পুরুষ সাম্য ও মর্যাদা বিবেচনায় শোভনীয় নয়। প্রকৃতপক্ষে woman শব্দটি এসেছে wifeman থেকে। যেখানে নারীর কোনো স্বতন্ত্র পরিচয় কিংবা আত্মবোধ বা মর্যাদা তুলে ধরা হয়নি। বরং পুরুষের লীলাসঙ্গী হিসেবে পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এখানেও নারীর পরিচয় কারো স্ত্রী হিসেবে। mistress শব্দের আদি অর্থ ছিল অবৈধ প্রেমিকা। শব্দটা বর্তমান গ্রহণযোগ্য অর্থে আসতে বেশ সময় নিয়েছে। madam (<ma dam = my lady) শব্দটি, আগে স্ত্রীলোকের প্রতি প্রণয় সম্বোধন প্রকাশে ব্যবহৃত হতো। চসার (Geoffrey Chaucer) এর সময়েও শব্দটির অর্থের অবনতি ঘটেনি। Restoration বা পুনরুদ্ধারকালীন ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শব্দটির অর্থের অবনতি ঘটে এবং অর্থ দাঁড়ায় বেশ্যাবাড়ির মালকিন। সাধারণভাবে যাকে আমরা মাসি বলে থাকে। এখন শব্দটির যথেষ্ট অর্থোৎকর্ষ ঘটেছে। বর্তমানে madam অসম্মানসূচক শব্দ নয়। অনেকে খ্যাতিমান মহিলাও শব্দটিকে মর্যাদাকর মনে করেন। তাই madam বর্তমানে সম্মানসূচক সম্বোধনে ব্যবহৃত একটি বহুল প্রচলিত মর্যাদাকর শব্দ।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা পূর্বকালে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে একটি জাতীয়তাবাদী শ্লোগান উঠেছিল- জিয়ে সিন্ধ। এটি উচ্চকিত হয়েছিল জয় বাংলার আগে। ঢাকায় তখন শ্লোগান উঠেছিল “বাঙালি – সিন্ধি ভাই ভাই!” বোনদের কথা ভাবা হয়নি। ধর্মীয় শিক্ষা অনুসারে আমরা বলি সকল মুসলমান ভাই ভাই। এখানেও বোনরা নেই।বাংলা ভাষায় একটি শব্দ আছে ‘পতিতা’। এর বিপরীত লিঙ্গে ‘পতিত’ হতে পারে। কিন্তু যে অর্থে আমরা ‘পতিতা’ ব্যবহার করি সেই অর্থে ‘পতিত’ ব্যবহার করি না। বেশ্যাবৃত্তি এখন আর কেবল দৈহিক অর্থেই ব্যবহার হয় না। কিন্তু তবু এর লিঙ্গান্তর হয় না।সাহস, শৌর্য, বীরত্ব এগুলোর লিঙ্গায়নও একচেটিয়া করা হয়েছে পুরুষের অনুকূলে। “সিংহ-পুরুষ আছে কিন্তু সিংহী নারী নেই।

প্রেসক্রিপশনে RX কেন লেখা হয়

#subach

Leave a Comment

তৎসম শব্দ চেনার কৌশল: শব্দ দেখামাত্র তৎসম শব্দ চেনার উপায়

ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম শব্দ চেনার কৌশল: শব্দ দেখামাত্র তৎসম শব্দ চেনার উপায়

বাংলায় ৫৫ ভাগের মতো শব্দ তৎসম। এগুলো চেনার কয়েকটি সহজ কৌশল নিচে দেওয়া হলো। তবে বাংলায় এমন অসংখ্য তৎসম শব্দ আছে যা নিচে লিখিত নিয়মের আওতায় পড়ে না। সেগুলো অধ্যয়নের মাধ্যমে চিনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এবার নিয়মকটি দেখে নেওয়া যাক :

১. প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম অনুযায়ী ঈ ঊ এবং ঋ আর এসব বর্ণের কারচিহ্ন (ী, ‍ূ, ‍ৃ) যুক্ত সকল শব্দ তৎসম।

২. মূর্ধন্য-ণ যুক্ত সব শব্দ তৎসম।মূর্ধন্য-ষ যুক্ত শব্দ সাধারণত তৎসম হয় কিন্তু কিছু কিছু শব্দ আছে যেগুলোর বানানে মূর্ধন্য-ষ থাকলেও তৎসম নয়। যেমন : খ্রিষ্টাব্দ, খ্রিষ্ট, পোষা, ষোলো, বোষ্টম প্রভৃতি তৎসম নয়।

৩. যেসব শব্দের পূর্বে প্র, পরা, অপ, সম, অব, অনু, নির(নিঃ), দুর(দুঃ), উৎ, অধি, পরি, প্রতি, উপ, অভি, অতি শব্দগুলো যুক্ত থাকে সেগুলো তৎসম।

৪. ক্ত্র, ক্ম, ক্ষ, ক্ষ্ণ, ক্ষ্য, ক্ষ্ম, ক্ষ্ম্য, গ্ধ, গ্ন্য, গ্ম, ঘ্ন, ঙ্ক্ষ, ঙ্ম, চ্ছ্ব, চ্ছ্র, জ্ঝ, জ্ঞ, ঞ্ছ, ঢ্র, ত্ত্ব, ত্ম্য, ত্র্য, দ্ব্য, দ্ম, ধ্ন, ধ্ম, ন্ত্য, ন্ত্ব, ন্ত্র, ন্ত্র্য, ন্দ্ব, ন্ধ্য, ন্ধ্র, ন্ন্য, ল্ম, শ্ছ, শ্ম, ষ্ক্র, ষ্ট্য, ষ্ট্র, ষ্ব, ষ্ম, স্ত্য, স্থ্য, হ্ন্য, হ্ম, হ্ল প্রভৃতি যুক্তবর্ণ শুধু তৎসম শব্দে দেখা যায়।

৫. বিসর্গযুক্ত এবং বিসর্গসন্ধিসাধিত শব্দসমূহ তৎসম।

৬ . বহুবচনবাচক গণ, বৃন্দ, মণ্ডলী, বর্গ, আবলি, গুচ্ছ, দাম, নিকর, পুঞ্জ, মালা, রাজি, রাশি প্রভৃতির যে কোনো একটি থাকলে ওই শব্দ তৎসম হয়।

৭. সমাসবদ্ধ পদের একটি অংশ তৎসম হলে অপর অংশ এবং সমস্তপদটিও তৎসম হয়। যেমন চন্দ্রমুখ শব্দে চন্দ্র অংশটি তৎসম সুতরাং ‘মুখ’ এবং ‘চন্দ্রমুখ’ শব্দদুটোও তৎসম।

৮. উপমান কর্মধারয়, উপমিত কর্মধারয় এবং রূপক কর্মধারয় সমাস গঠিত শব্দ সাধারণত তৎসম হয়।

৯. অব্যয়ীভাব এবং প্রাদি সমাস দ্বারা গঠিত পদগুলো সাধারণত তৎসম হয়।

১০. শব্দের শেষে তব্য ও অনীয় থাকলে তা তৎসম হয়। যেমন কর্তব্য, মন্তব্য, বক্তব্য, দ্রষ্টব্য, ভবিতব্য, করণীয়, দর্শনীয়, বরণীয়, রমণীয় প্রভৃতি তৎসম।

১১. শব্দের শেষে তা, ত্ব, তর, তম, বান, মান, এয়, র্য প্রভৃতি থাকলে সাধারণত ওই শব্দগুলো তৎসম হয়।

১২. অব্যয়পদের শেষে ত থাকলে (প্রথমত, অন্তত, জ্ঞানত) তা তৎসম হয়।

স্মর্তব্য : বাংলায় এমন কিছু শব্দ আছে যে শব্দগুলোর সংস্কৃত বানানে নাসিক্য বর্ণ ছিল কিন্তু নাসিক্য বর্ণ ছেড়ে তৎপরিবর্তে চন্দ্রবিন্দু ধারণ করে সংস্কৃত হতে পুরোপুরি বাংলায় চলে এসেছে। তাই চন্দ্রবিন্দুযুক্ত কোনো শব্দই তৎসম নয়। যেমন : চন্দ্র হতে চাঁদ, গ্রাম হতে গাঁও, বংশ হতে বাঁশ, অংশ হতে আঁশ প্রভৃতি তৎসম নয়।

সূত্র: ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

তৎসম চেনার কৌশল।

#subach

Leave a Comment

অণ্ডকোষ লিঙ্গ এবং জ্ঞানচর্চা

. মোহাম্মদ আমীন

অণ্ডকোষ লিঙ্গ এবং জ্ঞানচর্চা

অর্কিড একটি ফুল। এটি সৌন্দর্য, আনন্দ, পরিচর্যা, নান্দনিক রসবোধ এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। অনেকের কাছে নামটি নিজেই একটি মাধুর্য। গ্রিক orchis থেকে অর্কিড শব্দের উদ্ভব। যার অর্থ অণ্ডকোষ (লিঙ্গমূল)। ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে অণ্ডকোষ বা অর্কিড, ফুলের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। গ্রিক ভাষার অর্কিড, মধ্যযুগে ইংরেজি ভাষায় বলকওয়ার্ট নামে পরিচিত ছিল। ইংরেজি bullocks থেকে শব্দটি এসেছে। এর অর্থ অণ্ডকোষ বা লিঙ্গমূল। আধুনিক ইংরেজি শব্দ balls এর প্রাচীন রূপ beallucas। এর অর্থও অণ্ডকোষ বা লিঙ্গ।

অ্যাভোকাডো বিশ্বব্যাপী পরিচিত একটি ফল। বাংলাদেশেও ফলটি পরিচিত। স্পেনিশ aquacate থেকে অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে অ্যাভোকাডো শব্দের উদ্ভব। স্পেনিশরা, মেক্সিকান ahuakati থেকে শব্দটি গ্রহণ করে। এর অর্থও অণ্ডকোষ বা লিঙ্গ (penis)। ফলটি দেখতে অণ্ডকোষের মতো। তাই আজটেকরা এর নাম দেন ahuakati বা অণ্ডকোষ।

পেন্সিল (pencil) শব্দের প্রাচীন অর্থ উটের পশমে তৈরী নরম তুলি, যা দিয়ে শিল্পীরা ছবি আঁকেন। এর সঙ্গে pen ও penis শব্দের গঠনগত এবং অর্থগত মিল রয়েছে। pencil কিন্তু ইংরেজি শব্দ নয়। চতুর্দশ শতকের প্রথম দিকে ফরাসি pincel থেকে ইংরেজি pencil শব্দের সৃষ্টি। ল্যাটিন penicillus থেকে pencil শব্দের

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

উদ্ভব। এর প্রায়োগিক অর্থ রংতুলি বা পেনসিল হলেও প্রকৃত অর্থ penicillus। বাংলায় যার অর্থ, ক্ষুদে লেজ। স্মতর্ব্য, ল্যাটিন ভাষায় ‘ছোট লেজ’ মানে ‘শিশ্ন’ বা লিঙ্গ। কারণ এটি দেখতে ছোটো লেজের মতো।

অতএব, জ্ঞানের বাহন পেনসিল শব্দের মুল অর্থ শিশ্ন বা লিঙ্গ। ইংরেজি ভাষার শব্দ penis এর বাংলা শিশ্ন বা লিঙ্গ। শব্দটিকে দুই ভাগ করলে হয় pen is । যার সোজা বাংলা, এটি একটি কলম এবং অন্তর্নিহিত অর্থ জ্ঞান, সৃষ্টির ধারক, জ্ঞানচর্চা, জ্ঞানের সাধনা প্রভৃতি। কারণ কলম ছাড়া জ্ঞানের সাধনা ও সৃষ্টির বিকাশ সম্ভব নয়, যেমন সম্ভব নয় লিঙ্গ ছাড়া। অতএব জ্ঞানসাধনার মৌলিক দণ্ড pencil/ pen শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থও শিশ্ন, লিঙ্গ বা অণ্ডকোষ।

ইংরেজি musk শব্দটি বাংলায় বহুল প্রচলিত কস্তুরী শব্দের তুল্য। musk সংস্কৃত ‘মুষ্ক’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ। সংস্কৃতে মুষ্ক অর্থ অণ্ডকোষ বা লিঙ্গ। ইংরেজিতে pick শব্দের অর্থ ‘বাছাই’।বাছাই মানে চিন্তা ভাবনা করে গ্রহণ করা। তাই এর গুঢ়ার্থও জ্ঞানসাধনা। নরওয়েজিয়ান ভাষায় শব্দটির অর্থ ‘শিশ্ন’ বা লিঙ্গ। ইংরেজি fitter ফিটার শব্দের অর্থ এমন একজন দর্জি যিনি মাপানুযায়ী কাপড় কাটেন। কিন্তু নরওয়েজিয়ান ভাষায় ফিটার শব্দের অর্থ ‘নারীর যৌনাঙ্গ’।

যিশু খ্রিষ্টের কাছে যে তিন জ্ঞানী বক্তি উপহার আনিয়েছিলেন, তাদের মাগি বা magi বলা হয়। প্রাচীন পারসিক পুরোহিতমণ্ডলকেও মাগি বলা হতো। শব্দটির উৎসার্থ, সৃষ্টি তাড়নায় বিধৌত নান্দনিক পরিজ্ঞান। যার সাধারণ অর্থ শিশ্ন। বাংলায় মাগি শব্দের মূল অর্থ নারী কিন্তু এখন যৌনকর্মী।

প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে বুদ্ধিকে ‘লিঙ্গজ্যেষ্ঠ’ বলা হয়েছে। তাই বুদ্ধি মানে লিঙ্গ এবং লিঙ্গ মানে বুদ্ধি। ‘লিঙ্গপুরাণ’ নামে একটি পুরাণ আছে। যাতে জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সবিস্তার বিবৃত। ল্যাটিন লিঙ্গ (lingua) হতে ফরাসি (langage) শব্দের উদ্ভব এবং তা হতে মধ্যযুগে ইংরেজি (language) শব্দটি এসেছে। বাংলা `লিঙ্গ’ শব্দের সঙ্গে ল্যাটিন লিঙ্গ (lingua) এবং বর্তমান ইংরেজী language শব্দের মিল রয়েছে। কারণ language বা আদি লিঙ্গই হচ্ছে সৃষ্টি বা জ্ঞানসাধনের উপায়।বাংলায় লিঙ্গ শব্দটি অনেকের মনে প্রথমেই নিয়ে আসে শিশ্ন (penis)। তারপর আনে বাংলা ব্যাকরণে ব্যবহৃত gender ধারণা বা স্ত্রীলিঙ্গ-পুংলিঙ্গ। যেভাবেই আসুক লিঙ্গ শব্দটি বরাবরই জ্ঞান ও সৃষ্টিকে নির্দেশ করে।

প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে এবং বর্তমান বহু অভিধানে লিঙ্গ শব্দের প্রথম অর্থ ‘জ্ঞানসাধন, সৃষ্টি, সৌন্দর্য এবং দ্বিতীয় অর্থ চিহ্ন, লক্ষণ, প্রতীক ইত্যাদি। তাই লিঙ্গার্চনা মানে জ্ঞানের চর্চা, সুন্দর এবং সৌকর্ষের বন্দনা। তাই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে শিবলিঙ্গের পূজা জ্ঞানচর্চার একটি প্রতীকী রূপ। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর বঙ্গীয় শব্দার্থকোষে উল্লেখ আছে, শিব = শিখা বহনকারীে। যা বর্তমান অর্কিড-এর সঙ্গে তুল্য। তারা মনে করেন, শিবের মূর্তি জ্ঞানীদের চিন্তা-চেতনায় ফুটে ওঠা জগৎময় বিস্তৃত নান্দনিক অর্কিড। যা জ্ঞান, সৌন্দর্য ও সৃষ্টির অনন্ত উৎস।

সূত্র: বাংলা ভাষার মজা. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

Leave a Comment

বাল-আবাল, আবালবৃদ্ধবনিতা

. মোহাম্মদ আমীন

বাল-আবাল, আবালবৃদ্ধবনিতা

বাল: ‘বাল (√বল+অ)’ বাংলায় ব্যবহৃত একটি তৎসম শব্দ। এর আভিধানিক ও প্রায়োগিক অর্থ বালক, শিশু, কিশোর, প্রভৃতি। শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে : বালা ও বালি। বালা শব্দের অর্থ অল্পবয়সি মেয়ে, বালিকা, কন্যা, দুহিতা, যুবতী প্রভৃতি।‘বালি’ শব্দের অর্থ কিশোরী, বালিকা প্রভৃতি। ‘বাল’ শব্দ নিয়ে গঠিত শব্দরাশির কয়েকটি হলো : বালচর্চা (শিশুপালন),

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

বালবাচ্চা (ছোটো ছেলেমেয়ে), বালবিধবা (যে কন্যা বালিকা অবস্থায় বিধবা হয়েছে), বালবৈধব্য (বালিকা অবস্থায় বৈধব্যদশা), বালভোগ (বালক কৃষ্ণকে প্রদত্ত প্রাতঃকালীন ভোগ, বালভোগ্য (শিশুদের উপভোগের যোগ্য), বালসুলভ (বালকোচিত), বালসূর্য (নবোদিত সূর্য), বালশশী (শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ার চাঁদ) প্রভৃতি।

বালক: ‘বালক (বাল+ক)’ শব্দের অর্থ অল্পবয়স্ক পুরুষ সন্তান, অনূর্ধ্ব ষোলো বছরের পুরুষ, শিশু, অর্বাচীন, নির্বোধ, অপক্ব, অনভিজ্ঞ প্রভৃতি। ‘বালক’ শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে বালিকা।

আবাল: আ+বাল = আবাল। ‘বাল’ শব্দের ‘আ’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে ‘আবাল’ শব্দ গঠিত হয়েছে। বিস্তৃতি, পর্যন্ত, ব্যাপকতা প্রভৃতি প্রকাশে ‘আ’ উপসর্গটি ব্যবহৃত হয়। যেমন : আ + মৃত্যু = মৃত্যু পর্যন্ত। সে বিবেচনায় ‘আবাল’ শব্দের গঠনের সঙ্গে আকণ্ঠ, আপাদমস্তক, আমরণ, আসমুদ্রহিমাচল, আজীবন, আজন্ম প্রভৃতি শব্দের গঠনের মিল রয়েছে। গঠন অনুযায়ী আবাল শব্দের আভিধানিক অর্থ বাল্যাবধি, বাল্যকাল থেকে, অল্পবয়স থেকে, শিশুকাল থেকে প্রভৃতি। প্রসঙ্গত, আবাল শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে আবালি।

আবালবৃদ্ধ: ‘আবালবৃদ্ধ (আবাল+√বৃধ্+ত)” শব্দের অর্থ হচ্ছে বালক থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলে। এখানে শুধু বালিক ও বৃদ্ধের কথা বলা হয়েছে। কাজেই এটি পুঃলিঙ্গ জ্ঞাপক।

আবালবৃদ্ধবনিতা: আবালবৃদ্ধবনিতা শব্দটি আবাল, বৃদ্ধ ও বনিতা শব্দ নিয়ে গঠিত। সংস্কৃত বনিতা(=বনিত+আ) শব্দের অর্থ নারী, স্ত্রী, পত্মী, প্রেয়সী প্রভৃতি।বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, আবালবৃদ্ধবনিতা (=আবালবৃদ্ধ+√বন্+ইত+আ)’ শব্দের অর্থ বালক থেকে বৃদ্ধ এবং নারী পর্যন্ত সকলে।

অনেকে মনে করেন, ‘বাল’ শব্দের অর্থ ‘গোপনাঙ্গের কেশ’, এমন মনে করা সম্পূর্ণ অজ্ঞতা । অন্য ভাষার শব্দকে নিজ ভাষার শব্দার্থের সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হীনম্মন্যতাও বটে। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের কোথাও ‘বাল’ শব্দের অর্থ হিসেবে ‘গোপনাঙ্গের কেশ’ উল্লেখ নেই। তবে কেউ কেউ শব্দটিকে গালি হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। শুবাচে অপ্রাসঙ্গিকভাবে গালি হিসেবে শব্দটি উত্থাপন না-করার অনুরোধ রইল।

সূত্র: কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, . মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

Leave a Comment

চিকা মারা ও চিকা: চিকা মারো মারে রে

. মোহাম্মদ আমীন

চিকা মারা ও চিকা: চিকা মারো মারে রে

‘চিকা’ একটি দেশি শব্দ। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে ‘চিকা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, ছোটো চোখ ও সুচালো মুখবিশিষ্ট ঘন কোমল লোমাবৃত গাঢ় ধূসরবর্ণের স্তন্যপায়ী গায়ে দুর্গন্ধযুক্ত নিশাচর ইঁদুরজাতীয় প্রাণী, ছুঁচা, ছুঁচো, গন্ধমূষিক প্রভৃতি। চট্টগ্রাম এলাকায়ও  ‘চিয়া’ নামে পরিচিত। ‘চিকা’ শব্দের আর একটি অর্থ- গুণচিহ্ন (x)বা ঢ্যারাচিহ্ন। ‘চিকা’ ও ‘মারা’ শব্দ হতে ‘চিকা মারা’ কথার উদ্ভব। বাক্যে ক্রিয়াবিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত ‘চিকা মারা’ কথাটির আভিধানিক অর্থ দেওয়ালে লিখে বিজ্ঞাপিত করা, ছাপ মারা, ঢ্যারাচিহ্ন দেওয়া প্রভৃতি।

‘দেওয়াল লিখন’ বা দেওয়ালে লিখে বিজ্ঞাপিত করা কথাগুলো এখন ‘চিকা মারা’ কথাটির আড়ালে হারিয়ে গেছে। দেওয়াল লিখন বলিতে এখন ‘চিকা মারা’

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

বোঝায়। ‘চিকা’ বিশেষ্য হলেও ‘চিকা মারা’ কিন্তু ক্রিয়াবিশেষণ। চিকার বয়স যতই হোক, ‘চিকা মারা’ কথার বয়স বেশি দিনের নয়। তাহলে শব্দটির উৎপত্তি কখন এবং কীভাবে? এ নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন, এই গল্পের সূত্রে ‘চিকা মারা’ কথাটির উদ্ভব। আবার অনেকে মনে করেন, এটি নিছক গল্প। আগে গল্পটি কী দেখা যাক :

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন কারণে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গাছের ছোটো ছোটো ডাল ভেঙে ডালের আগা থেঁতলিয়ে ব্রাশের ন্যায় তুলি বানাত। নিচে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের উপরের অংশেও যাতে স্লোগান লেখা যায় সে জন্য তুলিগুলোকে লাঠির মতো লম্বা করে বানানো হতো। সে সব ব্রাশ বা তুলিতে আলকাতরা লাগিয়ে দেওয়ালে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের পক্ষে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরা হতো। স্লোগানসমূহে কড়া ভাষায় হুমকি দেওয়া হতো সরকারকে। এখনকার মতো তখনও সরকার-বিরুদ্ধ স্লোগান লেখা ছিল নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ কাজ করলে গ্রেফতার করা হতো। গ্রেফতারের ভয়ে শিক্ষার্থীরা সাধারণত রাতের বেলা টর্চ জ্বালিয়ে দেওয়ালে এ সব স্লোগান লিখতেন।

কথিত হয়, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের কোনও এক রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী  গাছের ডাল দিয়ে তৈরি লাঠি-আকৃতির লম্বা ব্রাশ দিয়ে দেওয়ালে স্লোগান লিখছিলেন। এ সময় একদল টহল পুলিশকে এগিয়ে আসতে দেখে শিক্ষার্থীরা ঝোপের আড়ালে আলকাতরার টিন লুকিয়ে লাঠির মতো লম্বা তুলি দিয়ে ঝোপঝাড়ে এলোপাথারি আঘাত করতে শুরু করে।টহল পুলিশ এগিয়ে এসে বলল, এত রাতে তোমরা বাইরে কী করছ?শিক্ষার্থীরা বলল, হলে চিকার জ্বালায় থাকতে পারছি না। ঝোপ দিয়ে হলে চিকা ঢুকে। আমরা লাঠি দিয়ে চিকা মারছি।

শিক্ষার্থীদের কথায় পুলিশের সন্তুষ্ট না-হয়ে কোনও উপায় ছিল না। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছিল একতলা এবং অধিকাংশ টিনসেডে ও স্যাঁতস্যঁতে মেঝে। পাশে ছিল ঝোপঝাড়, সেখান থেকে চিকা হলে হানা দিত। শুধু হলে নয়, পুলিশের ব্যারাকেও চিকার উপদ্রব ছিল। পুলিশ দল সন্তুষ্টচিত্তে চলে যায়। শিক্ষার্থীরা এবার দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল চিকা মারার ভানে ঝোপঝাড়ে আঘাত করতে থাকে আর এক দল দেওয়াল লিখন শুরু করে। এরপর থেকে ‘দেওয়াল লিখন’ লিখতে গেলে শিক্ষার্থীরা বলত চিকা মারতে যাচ্ছে। অনেকে আগে থেকে কয়েকটা চিকা মেরে সঙ্গে নিয়ে যত। এভাবে ‘দেওয়াল লিখন’ বাগভঙ্গিটি ‘চিকা মারা’ শব্দে পরিণত হয়। এখন শুধু দেওয়ালে নয়, রাস্তাতেও ‘চিকা মারা’ হয়, গাড়িতে এমনকি শরীরেও ‘চিকা মারা’ হয়।

‘চিকা মারা’ শব্দের উৎপত্তি নিয়ে উপরে বর্ণিত গল্পটির সত্যতা নিয়ে অনেকে সন্দেহ পোষণ করেন। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে ‘চিকা’ শব্দের দুটি অর্থ। একটি হচ্ছে- ছুঁচা, ছুঁচো, গন্ধমূষিক প্রভৃতি এবং অন্যটি হচ্ছে- গুণচিহ্ন বা ঢ্যারাচিহ্ন।বৈয়াকরণিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ছুঁচো অর্থ প্রকাশক ‘চিকা’ হতে নয়, বরং গুণ চিহ্ন বা ঢ্যারাচিহ্ন প্রকাশক ‘চিকা’ শব্দ হতে ‘চিকা মারা’ কথার উদ্ভব।

উৎস: বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

#subach/

 

Leave a Comment

অহংকার ও ব্যক্তিত্ব; ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব; অহংকার বনাম অহঙ্কার— কোনটি সঠিক

ড. মোহাম্মদ আমীন

অহংকার ও ব্যক্তিত্ব; ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব; অহংকার বনাম অহঙ্কার— কোনটি সঠিক

অহংকার ও ব্যক্তিত্ব:অহংকার’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ— গর্ব, বড়াই, অহমিকা, হামবড়ামি। অহমিকা, অহমহমিকা প্রভৃতি অহংকার শব্দের সমার্থক। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে,অহংকার (অহম্+√ কৃ+অ) অর্থ অহমিকা, গর্ব, দম্ভ, বড়াই; আত্মচেতনা, অহংজ্ঞান, অভিমান। ব্যক্তিত্ব: তৎসম ‘ব্যক্তিত্ব (ব্যক্তি+ত্ব)’ অর্থ— (বিশেষ্যে) ব্যক্তিবিশেষের বৈশিষ্ট্য, স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তির প্রকৃতি, ব্যক্তির সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য। ইংরেজিতে personality।যেমন: আমার বাবার ব্যক্তিত্ব আমার খুব প্রিয় ছিল। করিম নামের শিক্ষকটির ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করে। এই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব আমাকে মোহিত করে দিয়েছে।

ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব: “বাবা আমার প্রিয় ব্যক্তি। বাবাআমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব। কোন বাক্যটি শুদ্ধ? বাবা আমার প্রিয় ব্যক্তি’’ বাক্যটি সঠিক। ব্যক্তি: সংস্কৃত ব্যক্তি (বি+√অন্‌জ্+তি) অর্থ— (বিশেষ্যে) লোক, মানুষ; প্রকাশ (অভিব্যক্তি); ইংরেজিতে individual। যেমন: আমার বাবা আমার প্রিয় ব্যক্তি। ব্যক্তিটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। ব্যক্তিবিশেষের প্রতি আমার কোনো অবহেলা নেই। ব্যক্তিত্ব: সংস্কৃত ব্যক্তিত্ব (ব্যক্তি+ত্ব) অর্থ— (বিশেষ্যে) ব্যক্তিবিশেষের বৈশিষ্ট্য, স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তির প্রকৃতি, ব্যক্তির সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য। ইংরেজিতে personality। যেমন: আমার বাবার ব্যক্তিত্ব আমার প্রিয়। করিম নামের ব্যক্তিটির ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করে এই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব আমাকে মোহিত করে দিয়েছে। ব্যক্তি হচ্ছে বস্তুগত বিষয়— স্পর্শ করা যায়, ধরা যায়, দেখা যায়। এটি মানুষ বা লোক অর্থ প্রকাশ করলে গণনা করা যায়। ব্যক্তিত্ব অদৃশ্য বিষয়— ধরা যায় না; কেবল অনুভব করা যায়। ব্যক্তিত্ব কখনো গণনা করা যায় না। যদি কেউ বলেন, “বাবা আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব”। বাক্যটি আভিধানিক অর্থে সঠিক নয়। সঠিক বাক্যটি হবে, “বাবা আমার প্রিয় ব্যক্তি।”

অহংকার ও ব্যক্তিত্বের পার্থক্য: মূলত সংস্কৃত অহমহমিকা শব্দ হতে অহমিকা শব্দের উৎপত্তি। অহমহমিকা অর্থ দুজনের মধ্যে পরস্পর আমিই বড়ো, আমিই শ্রেষ্ঠ, আমিই উত্তম— এমন হামবড়া ভাব ও অযৌক্তিক দাবি। সর্বক্ষণ নিজেকে বড়ো ভাবা এবং অন্যকে নিজের তুলনায় ছোটো মনে করাই হচ্ছে অহংকার। যার মনে এমন বোধ ও চেতনা থাকে সে অহংকারী। অহংকার সর্বক্ষণ একজন মানুষকে আত্মশ্রেষ্ঠত্বে বিভোর রাখে বলে সে কখনো শান্তি পায় না। অহংকার নিয়ে বাংলা ভাষায় অনেক চমৎকার ও হৃদয়গ্রাহী কবিতা রয়েছে। ‘কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই বলে যদি ডাকো গলা দেব টিপে’; আনারস কাঁঠালকে বলে তুমি বড়ো খসখসে; ছালুনি বলে সুঁই, তোমার মাথায় ছ্যাঁদা। এগুলো সব অহংকারীর স্বভাব-প্রকাশক উক্তি।

প্রাত্যহিক জীবনে অহংকার কী? সহজ কথায়, ব্যক্তিত্বের বাজে অংশটাই অহংকার। গৃহীত খাদ্যের বাজে অংশটা যেমন মল, তেমনি ব্যক্তিত্বের বাজে অংশটা অহংকার। ইংরেজিতে যাকে বলে ইগো। ইগো আর গু দুটোই একই। তাই উভয়কে বর্জ্য-ব্যবস্থাপনার মতো অতি সাবধানে নড়াচড়া করতে হয়। জীবের জন্য গু অপরিহার্য। তাই বলে কেউ এটি শরীর-মাথায় কিংবা জামা-কাপড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না। গু নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষকে কেউ সহ্য করতে পারে না। তেমনি পারে না ইগো বা অহংকার নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষকে। দুজনই হতভাগা ও বন্ধুহীন। শিক্ষা মানুষকে নিরহংকার,কিন্তু ব্যক্তিত্ববান করে তুলে। শিক্ষা যদি অহংকারকে ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে না পারে তাহলে সে শিক্ষা বৃথা। শিক্ষার চেয়ে শিক্ষিত হওয়ার অহংকার যার মধ্যে প্রবল তার চেয়ে নিকৃষ্ট আর কে হতে পারে? কেউ না। অনেক অফিসারদের মধ্যে প্রচণ্ড অহংকার দেখা যায়। পদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অহংকারের মাত্রাও বেড়ে যায়।  অফিসার হওয়ার পর যার মধ্যে অমায়িক আর সেবাপরায়ণ হওয়ার চেয়ে অহমিকাবোধ প্রবল হয়ে উঠে তার চেয়ে ইতর আর কেউ হতে পারে না। এমন বোধ জন্ম নেওয়ায় তারা সাধারণ মানুষকে মনে করে দাস। নিজেদের মনে করে তাদের প্রভু।

“এরা শক্তের ভক্ত, এরা নরমের যম;
দুর্বলকে পিষ্ট করে, সবল পূজে পরম।
নিরীহদের তুই-তুকারি, বসকে বলে হুজুর,
সাধারণকে মনে করে বিড়াল-মাছি-কুকুর।
এদের ফুটানি বেশি, জানে কম—
এরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম।” — লেখক কেন মরে, ড. মোহাম্মদ আমীন

অহংকার বনাম অহঙ্কার: অহঙ্কার কি অশুদ্ধ: প্রমিত বানানবিধি অনুযায়ী, সংস্কৃত নিয়মে ম্-এর স্থলে অনুস্বার লেখা বিধেয়। যেমন: সম্‌+গীত= সংগীত; বিকল্পে সঙ্গীত; অলম্‌+কার= অলংকার; বিকল্পে অলঙ্কার। অনুরূপ: অহংকার ও বিকল্পে অহঙ্কার। সুতরাং, অহংকার ও অহঙ্কার (বিকল্পে ) দুটোই শুদ্ধ। তবে, বাংলা বানানের সমতা ও আদর্শ মান রক্ষার স্বার্থে অহংকার লেখা সমীচীন। বিকল্পে না যাওয়াই উত্তম। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে কেবল ‘অহংকার’ শব্দকে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে।

#subach

Leave a Comment